ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩ ফাইনালে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কতটুকু! বাংলাদেশ কবে বিশ্বকাপ জিতবে এমন একটি প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান বলেছিলেন ২০২৩ সালে জিতবে। কারণ এটা আমার শেষ বিশ্বকাপ। তামিম ইকবাল কনফিডেন্টলি বলেছিল প্রতিটি বিশ্বকাপে আমরা গেছি ভালো খেলার জন্য কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে আমরা যাব জেতার জন্য। কিংবদন্তি মাশরাফি বিন মুর্তজা বলেছিলেন সেমিফাইনাল কিংবা ফাইনাল বুঝিনা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের একটি টুর্নামেন্ট জেতা উচিত।
বাংলাদেশের কোটি ক্রিকেট প্রেমিকরা যেমন অনেক আগে থেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ জয় করবে। তেমনি বর্তমানে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও অনেকটা পজেটিভ মাইন্ডসেট নিয়ে এবারের বিশ্বকাপ মিশনে নামতে যাচ্ছে। ২০২০ সালের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে সেবার অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের অধিনায়ক আকবর আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি সাদামাটা দল বিশ্বকাপ মিশনে নেমেছিল। অন্য দলগুলো তুলনায় বাংলাদেশ দল ছিল একেবারেই একটি দুর্বল দল। কিন্তু বিশ্বকাপ মিশন সম্পর্কে আকবর আলী কে প্রশ্ন করলে আকবর আলী সোজা সাপটা বলেছিল আমরা বিশ্বকাপ জয় ছাড়া আর কিছুই ভাবছি না। আকবর আলীর এই কথাটা শুনে সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমত ট্রলের ঝড় উঠেছিল। কারণ আশেপাশের অনেক দেশের ক্রিকেট ভক্তরা আছে যারা বাংলাদেশের মানুষকে খুব ছোট করে দেখে। কিন্তু অনূর্ধ্ব ১৯ সেই বিশ্বকাপের আসরে বাংলাদেশ ঠিকই আকবর আলীর হাত ধরে প্রথম বারের মতো বিশ্বকাপ জয় করেই ঘরে ফিরেছিল। তাই স্বপ্নটা দেখতে হবে আকাশ ছোঁয়া।
এবারের বিশ্বকাপ নিয়েও বাংলাদেশ ক্রিকেটপ্রেমিকদের স্বপ্নটা অনেক বড়। ২০২৩ সালের এই বিশ্বকাপ হতে পারে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় বিশ্বকাপ। এমনকি বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জয় করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেন না। ক্রিকেটার সমালোচক কিংবা বাংলাদেশের কোটি ক্রিকেট ভক্তরা সবাই স্বপ্ন দেখছে সাকিব তামিমের হাত ধরেই আহমেদাবাদে শিরোপা জয়ের উল্লাস করবে বাংলাদেশ। আর কেনইবা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে এবারের বিশ্বকাপে এগিয়ে রাখছে পৃথিবীর রথি মহারথী অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষকরা। চলুন জেনে নেই উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে প্রথমেই যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রাখবে সেটা হলো অভিজ্ঞতা। কোথায় আছে Old is Gold আর বাংলায় সেই প্রবাদটি হয় পুরনো চাল ভাতে পারে। এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ দল নিয়ে মাঠে নামতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ দলের মূল ভিত্তি দলের সিনিয়ার প্লেয়ার সাকিব, তামিম এবং মুশফিক । এই তিনজন ক্রিকেটারের আছে চারটি বিশ্বকাপ খেলার দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী বিবেচনা করা স্বাগতিক ইন্ডিয়ান ক্রিকেট দলের মাঝেও বেশিরভাগ ক্রিকেটারই আছেন একেবারে তরুণ এবং নবাগত। যাদের নেই কোন বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা। অন্যদিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে তরুণ ক্রিকেটার লিটন তাসকিন এবং মেহেদী মিরাজ সবাই ইতিমধ্যে এক বা একাধিক বিশ্বকাপে নাম লিখিয়েছে। তাই তাদের থেকেও অনেক বেশি প্রত্যাশা থাকবে বাংলাদেশের কোটি ক্রিকেট প্রেমিক সমর্থকদের।
এছাড়া এবার বিশ্বকাপে সবচেয়ে পুরনো জুটি হিসেবে দেখা যাবে সাকিব এবং মুশফিক কে। তাই সবমিলিয়ে বাংলাদেশ দল অভিজ্ঞতার বিচারে বেশ ভালই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। বাকিটা মাঠের পারফরমেন্সে বলে দিবে কে হতে যাচ্ছে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
কন্ডিশন বিবেচনায়
বাংলাদেশকে বিশ্বকাপে ভালো করার জন্য সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রাখবে কন্ডিশন। কারণ ইন্ডিয়াতে বসবে এবারের বিশ্বকাপের আসর। আর এশিয়ার কন্ডিশনে খুব সহজে মানিয়ে নিতে পারে না নন এশিয়ান দেশগুলো। আর নিজেদের কন্ডিশনে এশিয়ার যেকোনো দল কতটা শক্তিশালী সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এশিয়ান দল গুলোর মধ্যে আমরা যদি বিবেচনা করি তাহলে প্রথমেই পাকিস্তানকে বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে। কারণ ওয়ানডে রেংকিং এ বর্তমান তারা নাম্বার ওয়ান দল। তবে পাকিস্তানের কাছে বর্তমানে কোয়ালিটি ফুল কোন স্পিনার নেই সেই সাথে পাকিস্তান হাইওয়ে পিছে খেলার কারণে বর্তমানে স্পিন বান্ধব পিছে তাদের অভিজ্ঞতা অনেকখানি কম। মূলত পেজ বোলিং নির্ভর পাকিস্তান স্প্রিং বান্ধব উইকেটে একটু ঝামেলায় পড়তে পারে।
এশিয়ার মাটিতে আফগানিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশ যে অনেক বেশি শক্তিশালী একটি দল সেটা সবাই চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে। এমনকি শক্তিশালী ভারতকেও নিজেদের দিনে টেনে হিস্রে মাটিতে নামিয়ে দিতে পারেন সাকিব তামিম এবং তাসকিরা। অন্তত বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে ২০০৭ সালের শিক্ষাটা আরেকবার নিতে পারে। তাই কন্ডিশন বিবেচনা করলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে অনেকের থেকেই।
টাইগারদের বোলিং অ্যাটাক
বিশ্বকাপ জেতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আরেকটি বড় চমক হতে যাচ্ছে টাইগারদের বোলিং অ্যাটাক। স্প্রিং বলে রয়েছে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। ওয়ানডে ক্রিকেটে যার ঝুলিতে আছে ৩০০ টির বেশি উইকেট। এছাড়াও বর্তমানে খেলছেন এমন বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারি তিনি। এছাড়াও তার সাথে রয়েছে মিরাজ এবং তাইজুলদের মতো পরীক্ষিত স্পিনার। ভারতে স্প্রিংবান্ধব উইকেটে তিনজনেই তিন মুখী অ্যাটাক কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা প্রতিপক্ষ দল হারে হারেই টের পাবে।
অন্যদিকে বিশ্বকাপের জন্যই পেস ইউনিটকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়েছে বাংলাদেশের পেজ বোলিং কোচ এনাল ডোনাল। মোস্তাফিজুর রহমান, তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদ এবং এবাদত হোসেনকে নিয়ে গোড়া বাংলাদেশের অসাধারণ পেজ অ্যাটাক কে সহজ ভাবে নেবার কোন সুযোগ নেই কোন দলের জন্য। কারণ নিজেদের দিনেই পেজ ইউনিটের বোলিং আক্রমণ কতটা ভয়ানক হতে পারে সেটার প্রমাণ ইতিমধ্যেই আমরা পেয়ে গেছি। পৃথিবীর যেকোনো ব্যাটিং লাইনআপ কে লন্ডভন্ড করে ম্যাচ নিজেদের করে নেওয়াটা এই বোলিং লাইন আপের জন্য খুব কঠিন কিছু হবে না। তবে অবশ্যই প্রশংসায় গা ভাসিয়ে নয় যা পরীক্ষা দেওয়ার সেটা দিতে হবে ২২ গজের মঞ্চে।
যেহেতু বাংলাদেশের ব্যাটিং সেকশন এখনো বিশ্বমানের হয়ে ওঠেনি। তাই বিশ্বকাপ জয় করতে হলে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব নিতে হবে বাংলাদেশের বোলারদেরকেই। এবং আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি বাংলাদেশের বোলিং ইউনিটের সেই সামর্থ্য আছে এমনকি অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই আছে।
এছাড়া বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পারফরমেন্স এর দিকে তাকালে দেখবেন কোচ চান্দিকা হাতুরি সিঙ্গে দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর দলের মধ্যে ইতিবাচক অনেকগুলো দিক ইতিমধ্যেই ফুটে উঠেছে। ক্রিকেটারদের মাঝে নিয়মিত জয়ের অভ্যাস তৈরি হয়েছে ২০১৫ সাল থেকে। ওয়ানডে ক্রিকেটে নতুন এক বাংলাদেশের পথ চলা দেখেছে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। মূলত ২০১৫ সালে বিশ্বকাপ খেলার পর বাংলাদেশকে কোন সহজ প্রতিপক্ষ ভাবতে পারেনা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দলগুলো। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন ট্রফির সেমিফাইনাল। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের ফাইনাল এছাড়া ২০১৯ সালে বাংলাদেশ জিতেছে প্রথম বহু জাতিক কোন সিরিজ। এ সময় বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বড় বড় দলকে হারিয়ে সিরিজ জিতেছে। এমনকি অনেক দল হোয়াইটওয়াশও হয়েছে। সাউথ আফ্রিকার মত দলকে তাদের মাটিতে হারানো কতটা কঠিন সেটা সবাই জানে। কিন্তু বাংলাদেশ সাউথ আফ্রিকাকে তাদের মাটিতেই হারিয়ে সিরিজ জিতে দেশে ফিরেছে।
মাঝখানে হয়তো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট ব্যবস্থাপনা। তবে আবার যেন নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়েছে। ২০২২ এর শেষের দিকে ইন্ডিয়াকে একপ্রকার নাকানি চুপানি খাইয়ে সিরিজ জিতে বাংলার টাইগাররা। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ হারলেও একটি ম্যাচে জয়ের দেখা ঠিকই পেয়েছে টাইগাররা।
আয়ারল্যান্ড এর বিপক্ষে সিরিজে ব্যাক টু ব্যাক দলীয় ৩০০ রান পার হয়েছে। এমনকি দশ উইকেটে জয়ের রেকর্ডেও রয়েছে। সব মিলিয়ে অনেকটা গোছানো এই দলটিকে নিয়ে ভরসা করাই যায়।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক্স ফেক্টর ক্রিকেটার অবশ্য সাকিব আল হাসানই হবেন। প্রায় এক যুগ ধরে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের আসনটিতে কাউকেই ভাগ বসাতে দেননি তিনি। একটিভ ক্রিকেটারদের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারি বোলার হিসেবে বিশ্বকাপে মঞ্চ মাতাতে যাবে এই ক্রিকেটার। অন্যদিকে একটিভ ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রানের দিক দিয়ে আছেন পাঁচ নাম্বার অবস্থানে। ব্যাট এবং বলের লড়াইয়ে সাকিব আল হাসান যে এবারের বিশ্বকাপের জন্য ভয়ংকর হতে যাচ্ছেন সেটা আর বলার অপেক্ষায় রাখে না। নিজের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতা কে কাজে লাগিয়ে যেকোনো ম্যাচের জয় পরাজয়ের এক্স ফেক্টর হতে যাচ্ছেন এই ক্রিকেটার।
গত বিশ্বকাপের আসরে নিজের সামর্থের প্রমাণ রেখেছেন তিনি। ২০১৯ বিশ্বকাপে ৮ ম্যাচ খেলে ৮৬ এভারেজে করেছিলেন ৬০৬ রান। উইকেট শিকার করেছিলেন ১১টি। ২টি সেঞ্চুরি ৫টি হাফ সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে সাকিব আল হাসান ২০১৯ বিশ্বকাপের অর্ধেক পারফরম্যান্স যদি এই বিশ্বকাপের আসরে করেন তাহলে বাকিটা সেরে নেওয়ার জন্য লিটন মিরাজ এবং তাওহীদ হৃদয় এর মত পরিক্ষিত ক্রিকেটাররা আছে। তামিম ইকবাল এবং মুশফিকুর রহিম নিজেদের শেষ বিশ্বকাপে নিজেদেরকে উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করতেই পারেন। তাই বলাই যায় সবদিক হিসেব-নিকেশ করলে এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলটি হতে পারে একটা এক্স ফ্যাক্টর ক্রিকেট টিম। কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে কিংবা আমাদের সঙ্গে হয়ে যাওয়া বরাবরের মতো চিটিংবাজি না হলে এবারের বিশ্বকাপে আমরা আমাদের স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখব ইনশাল্লাহ।
বন্ধুরা ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩ বাংলাদেশকে নিয়ে আপনার মতামত কি আমাদের কমেন্ট বক্সে জানিয়ে দিন এবং আমাদের মত আপনিও যদি চান যে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতুক তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে জানাতে ভুলবেন না। বাংলাদেশ ২০২৩ বিশ্বকাপের সকল খবরাখবর জানতে আমাদের সাইটটি ফলো করুন এবং সকল আপডেট পেতে আমাদের সঙ্গেই থাকুন ধন্যবাদ।