কোরবানির ইতিহাস! কোরবান মুসলমানদের জন্য একটি ওয়াজিব আমল। এর মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার নিকট নিজের প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে মুসলমানরা।
সূরা হাজের ৩৭ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, মাংস বা রক্ত কোনটাই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। পৌঁছায় তোমার মনের পবিত্র ইচ্ছা এই পবিত্র ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে মুমিনরা আল্লাহর রাহে প্রতিবছর আরবি মাস জিলহজের ১০ তারিখ কোরবানি করে থাকেন। কুরবানীর এই বিধান আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব।
তবে এই বিধান মুহাম্মদ (সঃ) এর পূর্ববর্তী নবী হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের সময় থেকে মুসলমানদের মধ্যে চলে আসছে। ভিকি মাসালা থেকে জানা যায় যারা জিলহজ মাসের ১০-১১ ও ১২ তারিখ নিজেদের নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ ব্যতীত অতিরিক্ত সাড়ে বারো তোলার রুপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা এর সমমুল্য অর্থের মালিক হয় তাহলে তাদের উপর কুরবানী করা আবশ্যক।
কুরবানী কে ইব্রাহিমের সুন্নাত বলা হয়ে থাকে। তবে ইব্রাহিম (আঃ) এর আগে হযরত আদম (আঃ) এর সময় থেকেই কুরবানী শুরু হয়। যখন আদম ও হাওয়া (আঃ) পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং তাদের সন্তান প্রজনন ও বংশবিস্তার আরম্ভ করে তখন হাওয়া (আঃ) এর গর্ভ থেকে জোড়া জোড়া অর্থাৎ একটি ছেলে ও একটি মেয়ে এরূপ জমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করত। তখন ভাইবোন ছাড়া আদম আঃ এর আর কোন সন্তান ছিল না।
অথচ ভাইবোন পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। তখন আল্লাহতালা উপস্থিত প্রয়োজনের খাতিরে আদম (আঃ) এর শরীয়তে বিশেষভাবে নির্দেশ জারি করেন যে একই গর্ব থেকে যে যমজ পত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে তারা সহোদর ভাই ও বোন হিসেবে বিবেচিত হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ব থেকে জন্মগ্রহণকারী কন্যা সহোদর হিসেবে গণ্য হবে না। তাদের মধ্যে পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ।
সুতরাং সে সময় হযরত আদম (আঃ) একটি জোড়ার মেয়ের সাথে অন্য জোড়ার ছেলের বিয়ে দিতেন। ঘটনা ক্রমে কাবিলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে ছিল পরমা সুন্দরী তার নাম ছিল আকলিমা অন্যদিকে হাবিলের সঙ্গে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে দেখতে অতটা সুন্দর ছিল না। তার নাম ছিল লিওজা।
বিবাহের সময় হলে শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী হাবিলের সহোদরা কুস্রি বোন কাবিলের ভাগে পড়লো। ফলে আদম (আঃ) তৎকালীন শরীয়তের আইনের পরিপন্থী কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তার নির্দেশ মানতে বললেন। কিন্তু সে মানলো না। এরপর তিনি তাকে বকাঝকা করলেন তবুও সে এসবে কান দিল না। অবশেষে আদম (আঃ) তার এ দু সন্তান হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন তোমরা উভয়ই আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী করো।
যার কুরবানী আল্লাহ তা’আলা গ্রহণ করবেন তার সঙ্গে আকলিমার বিয়ে দেওয়া হবে। সে সময় কুরবানী গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে সে কুরবানীকে জালিয়ে দিত। আর যার কুরবানী গ্রহণ হতো না তারটা পড়ে থাকত। যাইহোক তাদের কুরবানীর পদ্ধতি সম্পর্কে যা জানা যায় তাহলো কাবিল ছিল চাষী।
তাই তিনি গমের শীষ থেকে ভালো ভালো শীষ গুলো বের করে বাজে শীষ গুলোর একটি আঁটি কুরবানীর জন্য প্রস্তুত করলেন। আর অন্যদিকে হাবিল ছিল পশু পালন কারি। তাই তিনি খামারের একটি সুন্দর পশু কুরবানীর জন্য প্রস্তুত করলেন। এরপর নিয়ম অনুযায়ী আসমান থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের কুরবানীটি ভূষ্মিত করে দিল। আর কাবিনের কুরবানীটি যথাস্থানে পড়ে থাকলো। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম কুরবানী হিসেবে হাবিলের ওই কুরবানী গণ্য করা হয়।
সুতরাং প্রমাণিত হলো কুরবানী মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া কবুল হয় না তারপর থেকে বিগত সকল উম্মার জন্য কুরবানী অব্যাহত ছিল।
সূরা মায়েদার ২৭ নাম্বার আয়াতে এসেছে,
আদমের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও। যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল তখন একজনের কুরবানী কবুল হলো এবং অন্য জনের কুরবানি কবুল করা হলো না। তাদের এক জন বল্ল আমি তোমাকে অবশ্যই মেরে ফেলবো। অপর জন বল্ল আল্লাহ্ তো সংযমীদের কোরবানই কবুল করে।
জায়েদ ইবনে আরকাম (রা) বর্ণিত হাদিসে এসেছে, মহানবী (সঃ) এরশাদ করেন তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সুন্নত এই কোরবানি। ঐইতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায় স্বপ্নে আল্লাহ্র নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে এবং নিজ সন্তান হযরত ইসমাইলের সম্মতিতে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কোরবানি করার মানসিক প্রস্ততি গ্রহন করলেন।
এ উদ্দেশে প্রিয় ছেলে ইসমাইলকে নিয়ে একটি নির্জন স্থানে যান এবং তার চোখ বেধে মাটিতে শুয়ে দেন। তারপর কোরবানি করার জন্য ছেলের গোলায় ছুরি চালায়। কিন্ত আল্লাহ্ তালার নির্দেশ পালনের প্রতি পিতা ও পুত্রের অপরিসীম ত্যাগ শিকার করায় খুশি হন এবং হযরত ইসমাইল (আঃ) কে রক্ষা করেন। আর আল্লাহ্র তরফ থেকে পাঠানো একটি মেষ কে কিংবা দুম্বাকে হযরত ইসমাইল (আঃ) এর পরিবর্তে কোরবানি করা হয়।
বিভিন্ন নবীজির জীবনে কোরবানি
এছাড়া বিভিন্ন নবীজির জীবনেও কোরবানি করার বিধান দেখা যায়। ইলিয়াস (আঃ) এর যুগে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তত কালিন ইসরাইলের রানী ইসাবের ও ইলিয়াস (আঃ) কোরবানি করেন। আকাশ থেকে আগুন এসে ইলিয়াস নবীর কোরবানি পুড়িয়ে দিল। তৎক্ষণাৎ ঐ অঞ্চলের দুর্ভিক্ষ চলে গেল বৃষ্টি নেমে এলো এবং পত্তলিক রানী ইসাবেল এর ক্ষমতার পতন হল। এছাড়া হযরত নূহ (আঃ) মহাপ্লাবনের পর জাহাজ থেকে আল্লাহ্র উদ্দেশে শুকুরানা কোরবানি করেন।
হযরত মুসা (আঃ) এর লোহিত সাগর পারি দেওয়ার ঘটনার পর থেকে ঈদুল ফিসাদ পালন করতো ইহুদীরা এবং এখনও করে। মিশর থেকে মুক্তির কথা সরণ করে আল্লাহ তাদেরকে কুরবানীর করতে বলেছিলেন। তবে মুসলিমদের মত করে এখন ইহুদিরা কুরবানী পালন করে না। বর্তমান প্রচলিত কোরবানি হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর ঐতিহাসিক ত্যাগের মহান দিনটির কথা স্মরণ করিয়েই পালন করা হয়।
মহান আল্লাহর নিকট এই কোরবানি ছিল অধিক পছন্দনীয়। তাই সমগ্র মুসলিম জাতির সামর্থ্যবানদের জন্য কোরবানি কে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। এ থেকে পশু কুরবানীর প্রচলন শুরু হয় এবং ইব্রাহিম (আঃ) এর সুন্নত হিসেবে নবী কোরবানির বিধান উম্মতের জন্য পালনীয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইসলামী বিশ্লেষকরা বলেন কুরবানীর ঘটনায় হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাতালার প্রতি আনুগত্যের যে উপমা পেশ করেছেন, মহান আল্লাহ মিল্লাতি ইব্রাহিমের জন্য ওয়াজিব ইবাদত হিসেবে স্মরণীয় করে রাখলেন। হযরত ইব্রাহিম আঃ এর বন্ধুত্ব আল্লাহর প্রতি কত গভীর ছিল তা একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়।
হযরত ইসমাইল (আঃ) যখন চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলেন তখন প্রায় ১০০ বছর এর বৃদ্ধ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তিনি আল্লাহতালার পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সে সময় মিনা প্রান ধরে প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে কুরবানীর নির্দেশ পালন করেছিলেন। আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে তার মানসিকতা আল্লাহর কাছে কবুল হয়েছিল যা আজও মুসলিম উম্মা প্রতিবছর জিলহজ মাসে ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ এই তিন দিনের যে কোন একদিন পালন করে থাকেন।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাকে লোক দেখানোর জন্য কুরবানী নয় বরং পশু জবাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জনে মনের পশু ও আমিত্বকে জবাই করার এক অনন্য সুযোগ করে দেন। কোরবানি হোক নিজেকে তাকওয়াবান হিসেবে তৈরি করার মাধ্যম।
বন্ধুরা কোরবানি নিয়ে আমাদের এই পোস্টটি আপনাদের কাছে ভালো লাগলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানিয়ে দিবেন এবং এরকম ইসলামিক নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের সঙ্গেই থাকুন ধন্যবাদ।