গাঁজার নেশা ছাড়ানোর ওষুধ! গাঁজা মিষ্টি থেকে শুরু করে ঠান্ডা পানীয় পান করা হয় । গাঁজা বেশি খেলে ব্যক্তি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। অনেক সময় গাঁজার নেশা এতটাই হয়ে যায় যে সকালে, মাথা ব্যথা এবং বমি হয়। বিরক্তি, ঘাবড়ে যাওয়া এবং ঘুমে অসুবিধার মতো লক্ষণগুলি গাঁজা ব্যবহারের শেষ ১০ ঘন্টা পরে প্রদর্শিত হতে শুরু হয়। গাঁজার ব্যবহারের সাথে রক্তচাপ বেড়ে যায়, চোখ লাল হতে শুরু করে এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
গাঁজা খেলে কী কী ক্ষতি হয়?
গাঁজা সেবনের কারণে মানসিক ও শারীরিক সব ধরনের ক্ষতি হয়। সামাজিক দক্ষতা কমে যায়। দীর্ঘদিন গাঁজা খেলে এর ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। দিন দিন গাঁজা খাওয়ার মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। গাঁজা সেবনকারীরা ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়।
কখনো অতি আনন্দে আত্মহারা থাকে। আবার কখনো মনমরা থাকে। অনেক সময় কোনো কিছু মনে রাখাতে পারে না। অর্থহীন কথাবার্তা বলে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয়। চোখ লাল হয়ে যায়। প্রথম দিকে খাওয়াদাওয়া বেশি করে। ধীরে ধীরে খাওয়ার রুচি একেবারে কমে যায়।
রক্তচাপ কমে যায়। বুক ধড়ফড় করে। ধীরে ধীরে সবকিছু থেকে আনন্দ হারায়।নিজেকে সব সময় গুটিয়ে রাখে। ঘুমের নিয়ম বলে কিছু থাকে না। মানসম্মান ও ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয়। হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়। তখন অন্যকে আঘাত করে। অনেক সময় আত্মহত্যার চেষ্টাও করে।
বিনা কারণে অন্যকে সন্দেহ করে। স্বাস্থ্য ভাঙতে ভাঙতে দুর্বল হয়ে পড়ে। হৃদ্রোগ, ফুসফুস, লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একপর্যায়ে যৌনশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
গাঁজা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে কিছু সহজ নিয়ম অনুসরণ করলে
গাঁজার নেশা থেকে মুক্তি পেতে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা। কেউ যাতে গাঁজা খেতে না পারে, সে জন্য পরিবারে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে। বাংলাদেশে গাঁজা সহজলভ্য, এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কখন ফিরছে—এসব ব্যাপারে মা–বাবাকে খোঁজখবর রাখতে হবে।(গাঁজার নেশা ছাড়ানোর ওষুধ)
সন্তানকে গুণগত সময় (কোয়ালিটি টাইম) দিতে হবে। সন্তানের বন্ধু হতে হবে। তার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হবে। বন্ধু হয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। ক্ষতিকর দিকগুলো ভালোভাবে বোঝাতে হবে। যদি কারও মধ্যে হঠাৎ করে আচরণের পরিবর্তন দেখা যায় যেমন রাত জাগে, দিনে ঘুমায়।
কারণে-অকারণে মিথ্যা কথা বলে।ঠিকমতো স্কুলে যায় না, দেরি করে বাড়ি ফেরে, নতুন বন্ধুবান্ধব তৈরি হয়। অকারণে টাকা চায়। খারাপ আচরণ করে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিতে হবে।
গাঁজায় আসক্তির চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি
এর জন্য রোগী ও তার স্বজনদের ধৈর্য ধরতে হয়। এ সমস্যার দ্রুত কোনো সমাধান নেই। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। চিকিৎসকের নির্দেশমতো গাঁজার নেশা ছাড়ানোর ওষুধ খেতে হবে।
নেশায় জড়িয়ে পড়া, যেটির পোশাকি নাম হচ্ছে ‘মাদকাসক্তি’, তা আসলে মস্তিষ্কের রোগ! মাদকাসক্তিকে বলা হয় ‘ক্রনিক রিলাপ্সিং ব্রেইন ডিজিজ’ বা বারবার হতে পারে এমন মস্তিষ্ক রোগ। প্রথম দিকে কেউ কেউ নিজের ভালোলাগার অনুভূতিকে বাড়িয়ে তুলতে নেশা গ্রহণ করতে থাকে।
কেউবা হতাশা কাটাতে ভুল বিশ্বাস নিয়ে মাদক গ্রহণ করে। পরে চাইলেও নেশার এ চক্র থেকে বের হতে পারে না। তখন ভালোলাগার জন্য নয়, বরং ‘নিদারুণ খারাপ লাগা’ থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়ে নেশা করতে থাকে।
এই নেশায় আসক্ত হয়ে যাওয়া আর নেশা থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়টুকু বুঝতে হলে সবার আগে আমাদের মস্তিষ্ক ও এর গঠন সম্পর্কে কিছু জানতে হবে। মস্তিষ্কের কোষগুলোকে বলা হয় নিউরন বা স্নায়ুকোষ। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ বা নিউরোট্রান্সমিটারের মাধ্যমে এই নিউরনগুলো তথ্যের আদানপ্রদান করে।
গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিউরোট্রান্সমিটার হচ্ছে—গ্লুটামেট ওজিএবিএ, ডোপামিন, সেরোটনিন, নরএপিনেফ্রিন ইত্যাদি। গ্লুুটামেট নিউরনকে উদ্দীপ্ত করে, স্মৃতি আর শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। জিএবিএনিউরনকে নিস্তেজ করে।
ডোপামিন আনন্দ-অনুভূতিতে ভূমিকা রাখে; সেরোটনিন ঘুম, স্মৃতি, আবেগকে প্রভাবিত করে; নরএপিনেফ্রিন মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
এই নিউরোট্রান্সমিটারের মাধ্যমে নিউরনের উদ্দীপনা আর নিস্তেজের মধ্যে একটা স্বাভাবিক তাল-লয় থাকে বলেই আমাদের অনুভূতি, চিন্তা, মনে রাখা, শিক্ষণ প্রক্রিয়া এবং আচরণকে স্বাভাবিক রাখতে পারি। মনে রাখতে হবে, নিউরোট্রান্সমিটারগুলো সবই রাসায়নিক বস্তু।
আবার নেশার জন্য যে মাদকই গ্রহণ করা হোক না কেন, শরীরে প্রবেশ করে সেগুলোও কোনো না কোনো রাসায়নিক পদার্থে রূপান্তরিত হয়।ফলে মাদকের ‘রসায়ন’ নিউরোট্রান্সমিটারের কাজকে বাধাগ্রস্ত করে। এতে আমাদের অনুভূতি, চিন্তা, মনে রাখা, শিক্ষণ প্রক্রিয়া, আচরণ ইত্যাদি অস্বাভাবিক হয়ে যায়।
শুনতে আশ্চর্য মনে হলেও আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মস্তিষ্কেরও নিজস্ব কিছু আসক্তি সৃষ্টিকারী মাদকের মতোই বৈশিষ্ট্যযুক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে
যার মধ্যে রয়েছে অ্যান্ডরফিন ও অ্যানকেফালিন (হেরোইন, মরফিনের মতো কাজ করে), অ্যানানডামাইড (গাঁজার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন)। এগুলো খুব অল্প পরিমাণে থাকে এবং আমাদের শারীরিক ব্যথা উপশম ও অনুভূতির ওপর ইতিবাচক কাজ করে। বাইরে থেকে নেওয়া মাদক এগুলোর কাজকে খারাপভাবে প্রভাবিত করে।
এত গেল রসায়ন, গাঠনিক দিক থেকে মস্তিষ্কে একটি ‘সার্কিট’ থাকে, যাকে বলা হয় ‘রিওয়ার্ড সার্কিট’। স্বাভাবিক অবস্থায় বিভিন্ন ভালো বিষয় যেমন খাদ্য, পানীয়, খেলাধুলা, নিজের যত্ন, ভালোবাসা ইত্যাদি পেলে সেই সার্কিটটি উদ্দীপ্ত হয়—আমাদের মনে ও দেহে তখন ভালোলাগার অনুভূতি হয়, দেহ ও মন তৃপ্ত হয়। নেশার দ্রব্য গ্রহণ করলেও এই সার্কিট কৃত্রিমভাবে উদ্দীপ্ত হয় এবং তীব্র কিন্তু সাময়িক ভালোলাগা তৈরি হয়।
বেশির ভাগ মাদক বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে রিওয়ার্ড সার্কিটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘নিউক্লিয়াস একিউমবেন্স’ অঞ্চলে ‘ডোপামিন’-এর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে সার্কিটের অন্যান্য অংশ ব্যাসাল গ্যাংলিয়া, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, থ্যালামাস, হাইপোথ্যালামাস, ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া, এমিগডালা অঞ্চলের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। নেশার দ্রব্য বা মাদক কৃত্রিম হলেও অনেক শক্তি নিয়ে এই সার্কিটকে উদ্দীপ্ত করে। ফলে মাদকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় স্বাভাবিক ভালোলাগার বিষয়গুলো পরাজিত হয়।
তখন খাদ্য, পানীয়, নিজের যত্ন, ভালোবাসা ইত্যাদি ইতিবাচক বিষয়ে ‘রিওয়ার্ড সেন্টার’ উদ্দীপ্ত হয় না, সে কেবল মাদকই চায়। তখন স্বাভাবিক আনন্দ, মোটিভেশন কমে যায়, চিন্তা ও আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। উগ্রতা বেড়ে যায়। কারণে-অকারণে মিথ্যা বলে, স্বাভাবিক ঘুম নষ্ট হয়। রাত জাগে, দিনে ঘুমায়। মাদক গ্রহণ করার জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকে। মাদকের খরচ জোগাতে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
মাদক আমাদের মস্তিষ্কের রাসায়নিক কাজ এবং কাঠামোগত পরিবর্তন করে ফেলে। মাদকের কারণে মস্তিষ্কের পরিবর্তন হওয়াটাকেই বলে মাদকাসক্তি বা মাদক-নির্ভরতা। এ কারণেই মাদকাসক্তিকে বলা হয় মস্তিষ্কের রোগ।