পিরামিড তৈরীর রহস্য কি! পিরামিডি সম্ভবত সেই অতীত যার গোমোট ফাঁস হয়নি আজও। এখনো মাঝে মাঝেই পিরামিড হাজির হয় অভূতপূর্ব সব রহস্য নিয়ে।
এই যেমন গত মাসে ইজিপটেডের তথ্য বিভাগের গিজার গ্রেড, পিরামিডের ভিতর থেকে ৩০ ফুট লম্বা এবং ৬ ফুট চওড়া একটা সিলগালা করা সিক্রেট করিডোর আবিষ্কার করেন। এই করিডোর যেটা কুফুর পিরামিডের উত্তর দিকে অবস্থিত। সেটার কাজ যে আসলে কি বা এই করিডরের সিলগালা দরজার ওপারে কি আছে তা এখনো জানা সম্ভব হয়নি। এখানে জেনে রাখা ভালো এই কুফুর পিরামিডের ভিতর থেকেই ২০১৭ সালে বেরিয়েছিল আরেকটি রহস্যময় করিডর। যেটার দৈর্ঘ্য ছিল ৯৮ ফুট এবং যেটার রহস্য আজও অমীমাংসিত।
দা গ্রেট পিরামিড অফ গিজা কেন বানানো হলো
যদিও বলা হয় পিরামিড বানানো হয়েছিল ফাড়াও রাজাদের সমাধি হিসেবে ব্যবহারের জন্য। মৃত্যু পরবর্তী তাদের জীবনকে সম্মান করার জন্য। কিন্তু সত্যি এটাই যে পিরামিডের মধ্যে এখন পর্যন্ত একটি মোমিও পাওয়া যায়নি। অনেক ইজিপশিয়ান ফারাও মোমি যদিও “”এলি অব দ্য কিংযের বল্টে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সে বল্টের অবস্থানও পিরামিড থেকে বেশ দূরে। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম যদি সোমাদি হিসেবে পিরামিড নাই ব্যবহৃত হবে তাহলে কেন ২০ বছর ধরে ২ মিলিয়ন পাথর দিয়ে (যেখানে প্রত্যেক পাথরের ওজন আড়াই টন থেকে ৮০ টন) ৪২ তলা উঁচু ভবনের সমান “”দা গ্রেট পিরামিড অফ গিজা”” বানানো হলো।
এই প্রশ্নের উত্তর এনেছিলেন ক্রিস্টোফার ডান। প্রখ্যাত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস্টোফার ডান যিনি রীতিমতো নকশা করিয়ে দেখিয়েছিলেন, কিভাবে পিরামিডের আশেপাশের ভাস্কর্য গুলো নকশা মেনে তৈরি করা হয়েছিল।সেই বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার তার বই “”গিজা পাওয়ার প্লান্ট টেকনোলজিয়ান লজিস অফ ইনিসিয়ান ইজিপ্ট”” বইয়ে বিশ্লেষণ করে দেখান পিরামিডকে এনার্জি প্লান্ট হিসেবে ব্যবহার করার পিছনে কারণ আছে যথেষ্ট। পাশাপাশি এই বইয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন কিভাবে বিদ্যুৎ শক্তি তৈরি হতো। পিরামিডের ভেতরের নানান চেম্বারে। তার প্রমাণ কিংবা দাবি যে অমূলক নয় সেটার প্রমাণ হিসেবেই বোধ হয় সে সময় অনেক পিরামিডের দেয়াল থেকেই পাওয়া গিয়েছে বিস্ফোরক এবং কেমিক্যাল এনিমেলসের নানা রকম দাগও।
সেই সাথে ফাটলের বড় বড় ক্ষত চিহ্ন। প্রশ্ন উঠেছে তখন প্রায় ৩০০ টন ওজনের পাথর প্রচন্ড শক্তি ছাড়া সে পাথরের গায়ে ফাটলটা কিভাবে ধরল। তাছাড়া গ্রেট পিরামিডে এবং কিংস চেম্বারের দেওয়ালের গায়েও যে ফাটলের গভীর দাগ হলো সেটা কিভাবে। পিরামিডের ইন্টারনাল চেম্বার, জেগুল কিংস চেম্বার এবং কুইন চেম্বার নামে পরিচিত। তা মূলত দুর্লভ এক ধরনের গ্রানাইট দিয়ে গঠিত যার নাম “”রোজ গ্রানাইট””। যে গ্রানাইট বহু মাইল দূর থেকে আনা হয়েছিল গিজায়। মজার ব্যাপার হলো এই রোজ গ্রানাইটে রয়েছে সিলিকন ডাই অক্সাইড যা কোয়ার্ডস নামে পরিচিত।
এবার এই কোয়ার্ডস যখন সংকুচিত হয় কিংবা চলাচল করে তখন সে একটা চার্জ তৈরি করে যাকে পিজো ইলেকট্রিসিটি বলে। কোয়ার্ডসকে আমরা মডার্ন সব ডিভাইসে, যেমন টিভি, ঘড়ি, জিপিএস এই সব কিছুতেই খুঁজে পাই। ইন্টার্নাল কিংস এবং কুইন এর চেম্বারে যে রুলস গ্রানাইট পাওয়া গেছে তার ৮৫% ছিল কোয়ার্ডস।ইন্টার্নাল চেম্বারকে কানেক্ট করার টানেল এবং প্যাসেজ ওয়েতে ছিল ভালো পরিমাণে কোয়ার্ডস। যদি এই কোয়ার্ডস ঠাসা গ্রানাইট গুলোর উপরে ভালোভাবে প্রেসার দেওয়া হয় তাহলে তারা বেশ ভালো পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে।
কিভাবে পিরামিডে ইলেকট্রিসিটি তৈরি হতো
প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণা ও সিক্রেট চেম্বার গুলো থেকে পাওয়া কেমিক্যাল স্যেমপলে উঠে আসে অন্য তথ্য। সিক্রেট চেম্বার গুলোর একটি, কুইন্স চেম্বারকে ব্যবহার করা হতো কেমিক্যাল রিএকশনের জন্য।
যেখানে তৈরি হতো হাইড্রোজেন। এখন প্রশ্ন হল কিভাবে তৈরি হত এই হাইড্রোজেন।প্রথমত পিরামিডের ভেতরে দুই খাদ দুই দিক থেকে এসে মিলতো হতো কুইন্স চেম্বারে। উত্তর খাত থেকে আসতো হাইড্রোক্লোরিক এসিড দক্ষিণ খাত থেকে আসতো হাইড্রেট জিংক ক্লোরাইড। দুইটি কেমিক্যাল একত্রিত হয়ে তৈরি হতো হাইড্রোজেন। আর এই হাইড্রোজেন গ্যাস কুইন্স চেম্বার থেকে প্রবাহিত হয়ে হরাইজেন্টাল প্যাসেজ ধরে পৌছাতো গ্রান্ড গ্যালারিতে। যেখানে ছিল রুলস গ্রানাইট। হাইড্রোজেন গ্যাস গ্রানাইট গুলোকে চাপ দিত আর তৈরি হতো ইলেকট্রিসিটি।
নিকোলা টেসলা
আমরা এবার একটু তাকাই ভিন্ন দিকে। যেদিকের কুশীলব ইতিহাসের সবচেয়ে হতভাগা উদ্ভাবক যার নাম নিকোলা টেসলা। ক্যালকুলাসের বড় বড় অংক গুলো নিমিষেই করে ফেলা হোক কিংবা হোক টমাস আলভা এডিসনের সাথে দ্বৈরথ। এসি কারেন্ট আবিষ্কার কিংবা তিন সংখ্যা নিয়ে অফসেশন এইসব ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় চরিত্র হিসেবে নিকোলা টেসলা ছিলেন কতটা বিচিত্র। যদিও তার অনেক আবিষ্কার অনেকেই বেমালুম চুরি করেছে। তবুও এসবে না দমে তিনি সারা জীবন মত্ত ছিলেন বিজ্ঞানের সাধনাতে। সেই সাধনার সাথেই সম্পর্ক আছে পিরামিডের। অবাক হচ্ছেন?
নিকোলা টেসলা যদিও জীবনভর নানা ধরনের গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন তবুও মোটা দাগে ধরলে গোটা জীবনে তার তিনটা উদ্ভাবন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।১/ ইন্ডাকশন মোটর এসি, ২/অল্টারনেটিভ কারেন্ট এবং ৩/ হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার সিস্টেমকে মাইলের পর মাইল ধরে ব্যবহার করার সংহতি অসংগতি। তবে এসবের পাশাপাশি ওয়ারলেস পাওয়ার সাপ্লাই নিয়েও বিস্তর গবেষণা করেন তিনি, এবং এই গবেষণার একপর্যায়ে এসেই তিনি ঘোষণা করেন পিরামিড আসলে একটা ওয়ারলেন্স পাওয়ার প্লান্ট।
এর পরই নিকোলা টেসলা পিরামিড নিয়ে শুরু করেন সিরিয়াস গবেষণা। ১৯০৫ সালে টেসলা “”দ্য আর্ট অফ ট্রান্সমিটিং ইলেকট্রিক্যাল এনার্জি থ্রু দা নেচারাল মিডিয়াম”” নামে একটা ফাইল নোট করে। এরপর এই প্যাটার্নটির কনসেপ্ট এর উপর ভিত্তি করে টেসলা শুরু করলেন তার ড্রিম প্রজেক্ট ওয়ারডেন ক্লিফ টাওয়ার প্রজেক্ট। টেসলা পিরামিডের মত পৃথিবীর কম্পন ব্যবহার করে শক্তি উৎপন্ন করে তা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বিনামূল্যে সবাইকে। যে জন্য মূলত ওয়াডেন ক্লিফ টাওয়ারের সৃষ্টি। যে টাওয়ারের প্রথম পরীক্ষা তিনি শুরু করেন ১৮৯৮ সালে নিউইয়র্কে ।কিন্তু নিউইয়র্কের এই এক্সপেরিমেন্টের কিছু রিক্স ফ্যাক্টর ছিল।
যে কারণে তাকে যেতে হয় ফ্লোরিডায়। লোক চক্ষুর অন্তরালের আড়ালে গিয়ে এই টাওয়ারের এক্সপেরিমেন্টের জন্য। কিন্তু এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করেন এখানে প্রচুর অর্থের দরকার। তাই এই ফান্ডের জন্য টেসলা দ্বারস্থ হন তার ছোটবেলার বন্ধু মর্গানের কাছে। পাশাপাশি মরগান বিজ্ঞান অনুরাগীও ছিলেন।তাই টেসলা তার কাছে যাওয়াই মন স্থির করেন। কিন্তু টেসলা মর্গানকে কি কি বিষয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে চান সেটি না বলে অন্য একটি মিথ্যা প্রজেক্ট এর নাম করে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলার নেয়।
অর্থের যোগান হওয়ার পর টেসলা আবার পরীক্ষা শুরু করেন। কিন্তু যেহেতু এটা ছিল একটি খুবই ব্যয়বহুল প্রজেক্ট তাই মরগানের দেওয়া টাকা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো। টেসলা তখন এক্সপেরিমেন্টের একেবারেই শেষ পর্যায়ে ছিলেন। পুরো প্রজেক্ট কমপ্লিট করার জন্য তিনি আবার দারস্ত হন মরগানের। কিন্তু মরগান এরই মধ্যে জেনে গেছেন টেসলার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে। তাই তিনি কেসলাকে টাকা না দিয়ে পুরো প্রজেক্ট টাই বন্ধ করে দেন।
তবে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার। জেপি মরগান কেন টেসলার প্রজেক্টে আর অর্থলোগ্নী করলেন না তার পেছনে আরো বেশ কিছু কারণ ছিল। প্রথমত তিনি ছিলেন জেনারেল ইলেকট্রিকের মালিক। এছাড়া তিনি ছিলেন কপার মাইনেরও মালিক। যে কপার তার তৈরিতে ব্যবহৃত হয।, রবার ফার্মের মালিকও ছিলেন তিনি যেটি তারের ইন্সুলেশনের জন্য ব্যবহার করা হয়। টিম্বার মিলের মালিক ছিলেন তিনি। যে মিল টেলিগ্রাফ এবং ইলেকট্রিক পোল তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়।কয়লা খনির মালিক ছিলেন তিনি যা পাওয়ার প্লান্টের জ্বালানি হিসেবেও কাজ করতো। টেসলার প্রজেক্টে ফান্ডিং করে ওয়ারলেন্স ইলেকট্রিসিটি চালু হলে তার এইসব ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেত। এই কারণে তিনি অর্থ তো দেয়নি পাশাপাশি অন্যরাও যাতে টেসলাকে সাহায্য না করে সে ব্যবস্থাও করেন। একরকম এক ঘরেই করে ফেলা হলো টেসলাকে।
পরবর্তীতে মরগান ফাউনন্ডিং দিলেন অ্যাডিশন আর মার্কোনিকে। ফলে তারা আরও প্রচুর অর্থের মালিক হতে লাগলেন। আর টেসলা ধীরে ধীরে নিঃস্ব হয়ে গেলেন। একসময় টেসলার এতই পরিমাণ দেনা জমে গেল যে ব্যাংক তার ওয়ার্ডেন ক্লিফ প্রজেক্ট বাতিল করে দিল। ১৯১৭ সালে টেসলার পুরো প্রজেক্ট টাই ভেঙে ফেলা হলো।
এখানেই দীর্ঘশ্বাস। যদি ঠিকমতো অর্থ পেতো টেসলা তাহলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে যেত এতদিনে। পিরামিড আসলে জায়েন্ট পাওয়ার সোর্স হিসেবে কাজ করে কিনা সেটা যেমন জানা যেত তেমনি ফ্রি ওয়ারলেস ইলেকট্রিসিটি আবিষ্কার করে সারা পৃথিবীকে আমুল পাল্টে দেওয়া যেত।১৯৪৩ সালে টেসলা মারা যাওয়ার সাথে সাথে এই আবিষ্কার সংক্রান্ত সমস্ত তথ্যই ক্রমশ মুছে ফেলা হয়। যদি ওয়ার্ডেন ক্লিফ টাওয়ারের এক্সপেরিমেন্ট ঠিকঠাক হতো এবং আসলেই যদি পৃথিবীর এই কম্পন কে ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করা যেত তাহলে তারহিন বিদ্যুৎ শক্তির সুফল পেত সারা পৃথিবী।
যেহেতু মন্দ ভাগ্য সারা জীবনই ছায়ার মতো লেগেছিল টেসলার সাথে। সেটুকু মেনেই তার দিনশেষে এই প্রজেক্টটিও হয়েছে নিঃশেষ। পৃথিবীবাসিও, মানে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। সেই সাথে প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে এই প্রশ্নগুলি পিরামিডকে কারা এনার্জি প্লান্ট হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল? আর কেনইবা চেয়েছিল? কেনইবা হুট করে বন্ধ হয়ে গেল এই প্রসেস? আগেকার সময়ের মানুষের বিদ্যুতের দরকারই হচ্ছিল কে?