রাজনীতি

ব্রিক্স এর কাজ কি? কেনইবা ব্রিক্স গঠন করা হয়েছে

ব্রিক্স সম্মেলন ২০২৪ কোথায়! বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম ব্রিক্স। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিক্স নামের এই শক্তি আন্তঃসরকারি সংস্থাটি গড়ে তুলেছে।

ব্রিক্স সম্মেলন ২০২৪ কোথায়

সমগ্র ভূপৃষ্ঠের ২৬.৭ শতাংশ অঞ্চল ব্রিক্সের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।ব্রিক্স অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতেই সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক লোক বাস করে।ব্রিক্সের সম্মিলিত জিডিপি সমগ্র বিশ্বের ৪ ভাগের একভাগ। ব্রিক্স সদস্যগুলো একে অপরের সাথে আরো বেশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এর ফলে দেশগুলোর অর্থনীতি আরও অনেক বেশি সম্প্রসারিত হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে ব্রিক্স ভুক্ত দেশগুলো ইউএস ডলারকে পাশ কাটিয়ে স্বর্ণ মানের উপর ভিত্তি করে এক ধরনের নতুন রিজার্ভ কারেন্সিও তৈরি করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্রিক্সে যোগ দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ব্রিক্সের কাজ কি? এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ব্রিক্সের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হবে আজকের এই পোস্টটিতে। তাই বন্ধুরা পোস্টটি স্ক্রিপ্ট না করে পুরো টি করার অনুরোধ রইল। আশা করি এর মাধ্যমে আপনি ব্রিক্সের সকল আদ্যপ্রান্ত জানতে পারবেন। তাহলে চলুন শুরু করি আজকের পোস্টটি।

ব্রিক্স কি

ব্রিক্স মূলত বিশ্বের উদয়মান অর্থনীতির একটি সংগঠন। যারা বিশ্ব রাজনীতির পরিমণ্ডলে ক্রমশই তাদের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। জিম অনিল নামের একজন অর্থনীতিবিদ সর্বপ্রথম ব্রিক্স এর ধারণাটি নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি ২০০১ সালে একটি গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, ব্রাজিল, রাশিয়া, চায়না এবং ভারত আগামী দশকে বিশ্ব অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের পরিণত হবে। ২০০৯ সালের রাশিয়ায় দেশগুলোর সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিক সম্মেলনের মাধ্যমে ব্রিকসের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্রিক্সসের দেশগুলো শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয় জনশক্তি এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকেও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ থেকে অনেক এগিয়ে আছে। সেই সাথে বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর নয়টি দেশের তিনটি দেশেই ব্রিক্সসের সদস্য।

ব্রিক্সের উদ্দেশ্য

সে কারণে তারা একত্রে বিশ্ব রাজনীতি এবং সামরিক দিক থেকেও এক ধরনের মহা জোটে পরিণত হয়েছে। ব্রিক্সের মূল উদ্দেশ্য হলো এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। এর অন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য হলো বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলা। যেখানে কোন একক দেশ বিশ্ব মোড়ল থাকতে পারবে না। অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্রিক্সের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে চায়। সেই সাথে টেকসই উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্রিক্স দেশগুলো বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। এটিকে অনেকে ব্রিক্সের ব্যাংকও বলে থাকে। এই ব্যাংকের কাজ হলো ব্রিক্স এবং ব্রিক্সের বাইরে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করা।

ব্রিক্সের চ্যালেঞ্জ

ব্রিক্স সদস্য দেশগুলো অভিন্ন লক্ষণ নিয়ে কাজ করলেও তাদের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাশিয়া, চীন, ভারত, ব্রাজিল কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক কাঠামোতে ব্যাপক বৈচিত্র এবং বৈপরীত্য রয়েছে। এছাড়া দেশগুলো অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বেশ আলাদা। ভারত এবং চীনের মধ্যে একাধিক অঞ্চলের সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাছাড়া চীনের অর্থনীতি অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে অনেক বড়। চীনের এই অবস্থান ভবিষ্যতে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। অন্যদিকে রাশিয়ার অর্থনীতি বিগত এক দশক ধরে অনেকটা স্থবির অবস্থায় রয়েছে ।

ব্রাজিলের অর্থনীতিও বিগত ১০ বছরে প্রায় অর্ধেক নেমে এসেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থা অনেকটা একই রকম। এই জোটের সবচেয়ে বড় শক্তি চায়নার অর্থনীতিও যত বড় হচ্ছে তাদের ঝামেলাও তত বাড়ছে। ব্রিক্স ভুক্ত দেশের মধ্যে ভারত সবচেয়ে দরিদ্র দেশ। কিন্তু সদস্য দেশগুলোর মধ্যে উজ্জ্বল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ভারতেরই সবচেয়ে বেশি। কারণ দেশটির  জনশক্তির উল্লেখযোগ্য একটি অংশ দক্ষ এবং শিক্ষিত বলে মনে করা হয়।

নিজস্ব সাবমেরিন ক্যাবল তৈরি করা

ব্রিক্স সদস্যরা নিজস্ব সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে তাদের দেশগুলোকে যুক্ত করতে চাইছে। কারণ অধিকাংশ কেবল কোনো না কোনো ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড অতিক্রম করে। মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা এসব কেবলে নিয়মিত নজরদারি করে থাকে। যার ফলে তাদের গোপন তথ্য ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। রাশিয়ার, চায়না এবং ভারতের জন্য এই বিষয়টি বাস্তবায়ন করা খুব বেশি কঠিন নয়। কারণ তারা ভৌগোলিকভাবে খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। দক্ষিণ আফ্রিকা খুব বেশি দূরে নয়। তবে বিশাল এক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ব্রাজিলকে একই কেবলের সাথে যুক্ত করা একটি বিশাল চ্যানেল।

বিশ্বের অর্থনীতি উন্নয়নে ব্রিক্স

বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বিশ্বকে বদলে দেওয়ার মত ব্রিক্সের নানা কার্যকারিতা রয়েছে। যেমন চীনকে এখনো সমগ্র বিশ্বের কারখানায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাশিয়া এবং ব্রাজিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সম্পদের সমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম ও জনশক্তি রয়েছে ভারতে। তাছাড়া বিশ্বের প্রায় ৪১.৫%  জনসংখ্যা ব্রিক্স দেশগুলোতে বাস করে। সে কারণে বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়নে এই জোটের ভূমিকা অনুস্বীকার্য।

জাতিসংঘ এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ব্রিক্সের দেশগুল বহু আগে থেকেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায় ব্রিক্স এর নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং আইএমএফ এর আধিপত্য কমাতে কাজ করে যাচ্ছে। ব্রিক্স আরো নতুন নতুন সদস্য সংগ্রহের বিষয়েও আগ্রহী। সৌদি, আরব, ইরান, আরব আমিরাত, মিশর, বাহারাইন, আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়া এবং বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিক্সের সদস্য পদের জন্য আবেদন করেছে। আরো বেশ কিছু দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এই জোটে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন।

কেন এত এত দেশ ব্রিক্সে যোগ দিতে চাচ্ছে?

বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন এই দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের অর্থনৈতিক খবরদারি এবং অনাকাঙ্খিত নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচতে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। সেই কারণে তারা নতুন এক   বিশ্ব ব্যবস্থার অংশ হতে চাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে তাদেরকে নানা মুখি নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়েছে। অন্যদিকে চীনের সাথে আমেরিকার বেশ কিছু বিষয়ে দ্বন্দ রয়েছে বিশেষ করে তাইওয়ান ইস্যুতে আমেরিকা এবং চীন সামরিক দিক দিয়ে অনেকটা মুখোমুখি অবস্থান করছে। আমেরিকার সঙ্গে মতের অমিল হলেই যেন নিষেধাজ্ঞায় পরতে না হয়। সেজন্য বিকল্প এক বিশ্ব ব্যবস্থা অতি জরুরী বলে মনে করছে ব্রিক্স সদস্যরা।

ব্রিক্স সম্মেলন ২০২৪ কোথায়

আমেরিকার অর্থনৈতিক শক্তিকে পুঁজি করে তারা সারা বিশ্বে তাদের সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। ব্রিক্স  যদি তাদের পরিকল্পনা মত আর্থিক সাফল্য অর্জন করতে পারে তাহলে মার্কিন সামরিক প্রভাব অনেকটা দুর্বল হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পশ্চিমা কেন্দ্রিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যদি এশিয়ার দিকে সরে আসে। তাহলে ব্রিক্স এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ব্রিক্স এর সদস্য দেশগুলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় অর্থনৈতিক দেশে পরিণত হবে। এর সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে হলে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলতে হবে।

ব্রিক্সের আনুষ্ঠানিক সূচনা

ব্রিক্সের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা প্রবর্তনের সময়ে। ব্রিক্সের প্রথম সম্মেলনের মাত্র এক মাসের মাথায় তারা নতুন এক বৈশ্বিক রিজার্ভ কারেন্সি নিয়ে আলোচনা করে। যা হবে ডলারের চেয়ে অনেক বেশি স্থিতিশীল এবং যার মূল্য হবে সর্বোচ্চ।

ডলারকে যে কারণে বৈশ্বিক রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল ডলার সেই মূল বিষয়টি থেকেই সরে গেছে। প্রতিটি ইউএস ডলার স্বর্ণ মানের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হলেও বর্তমানে স্বর্ণের সাথে ডলারের কোন সম্পর্ক নেই। বিকল্প রিজার্ভ কারেন্সি নিয়ে ব্রিক্স জোটে আরো বহু বছর আগে থেকেই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে স্বর্ণমান সম্পন্ন নতুন রিজার্ভ কারেন্সি প্রতিষ্ঠার জন্য চীন এবং রাশিয়া গোপনে গোপনে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ মজুত করতে শুরু করেছে।

মার্কিন ডলার কিভাবে রিজার্ভ কারেন্সিতে পরিণত হয়েছিল এবং চীন ও রাশিয়া কিভাবে নতুন  কারেন্সি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে আমাদের পরবর্তী পোস্টটি ফলো করুন ধন্যবাদ।

Related Articles

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।