ট্রাভেল

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেল সেতু এখন যমুনার বুকে

বঙ্গবন্ধু সেতু

যমুনা সেতু! ইতোমধ্যে এই সেতুর ৩৮টি পিলারের পাইলিংয়ের কাজ শেষ। আরো বেশ কয়েকটি পিলারের পাইলিংয়ের কাজ শেষের দিকে। জুন পর্যন্ত এই সেতুর অগ্রগতি ৪২ শতাংশ।

দিন যতই যাচ্ছে ততই দৃশ্যমান হচ্ছে বঙ্গবন্ধু রেল সেতু। সেতুটি নির্মাণ হলে একদিকে যেমন উত্তরের যোগাযোগ খাতে নবদিগন্তের সূচনা হবে তেমনি খুলবে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর (এডিডিআই) অতিরিক্ত চিফ প্রকৌশলী মো. আহসান জাবির।

বর্তমানে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর-কালিহাতী ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা এই দুই প্রান্তে রেল সেতু নির্মাণে ৫০টি পিলারের মধ্যে অর্ধেকের বেশি পিলারের পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। সেতু এলাকায় সরেজমিন ঘুরে ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে এসব তথ্য।

রেল সেতুর পিলার সম্পন্ন

বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশেই ৪.৮ কিলোমিটার দুই লাইনের রেল সেতুর ৫০টি পিলারের মধ্যে ৩৮টির পাইলিংয়ের কাজ শেষ। বাকিগুলোর কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। সেখানে রাত-দিন কাজ চলছে। ২০২১ সালের মার্চে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়। ইতোমধ্যে শেষ হওয়া পিলারগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। তবে মাঝামাঝি পর্যায়ে সিরাজগঞ্জ অংশে বাদ রয়েছে ৮টি পিলারের পাইলিং কাজ।

কাজের অগ্রগতি বেশ ভালো জানিয়ে এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, ২০২৪ সালের ১০ আগস্টে নির্ধারিত সময়ে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি। টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ সীমান্তে ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হলে রাজধানীর সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ শুরু হয়।

তবে ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ায় ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। এতে সময়ক্ষেপণসহ শিডিউল বিপর্যয়ে যাত্রীরা প্রায়ই ভোগান্তিতে পড়েন। এরপরই বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণের চিন্তা সামনে আসে। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জাপান ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে জাইকা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে

যমুনা নদীর দুই প্রান্তে দুটি ভাগে চলছে নির্মাণকাজ। ইতোমধ্যে সেতুর পূর্বপাশে টাঙ্গাইল অংশে ৪৭ ও ৪৮ নম্বর পিলারের মাঝে সুপার স্ট্রাকচার গার্ডারের কাজ শুরু করা হয়েছে।প্রকল্প পরিচালক বলেন, আগে কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে নদীর দুই প্রান্তে সমানতালে কাজ চলানো সম্ভব হয়নি। তবে এখন বেশ জোরেসোরে কাজ চলছে।

নদী ওপর মহাকর্মযজ্ঞ; যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে প্রকল্প এলাকায় চলছে মহাকর্মযজ্ঞ। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে পাইলিংসহ সেতু নির্মাণ সংশ্লিষ্ট নানা কাজ। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘিরে রাখা হয়েছে প্রকল্পের এলাকা।

বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ৩০০ মিটার উজানে সেতুপূর্ব-উত্তর পাশের গাইড বাঁধের কাছ থেকে পাইল বসানোর কাজ শুরু হয়। এখন ভারি ক্রেনের সাহায্যে হ্যামার দিয়ে বসানো হচ্ছে পাইলিং পাইপ। হ্যামারের শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে পুরো প্রকল্প এলাকা। প্রকল্পে দেশি ও বিদেশি কোম্পানির কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৪.৮ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেল সেতু নির্মাণ। এই প্রকল্পের মধ্যে আরো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে উভয় প্রান্তে ০.০৫ কিলোমিটার ভায়াডাস্ট, প্রায় ৭.৬৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ এমব্যাংকমেন্ট এবং লুপ ও সাইডিংসহ মোট প্রায় ৩০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ।

এছাড়া সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে থাকবে নতুন স্টেশন ভবন, ইয়ার্ড রিমডেলিং ও রেলওয়ে সেতু মিউজিয়াম। একই প্রকল্পের আওতায় কিছু নদী শাসন ও সংস্কার কাজও করা হচ্ছে।

রেল বিভাগ বলছে, ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ; ডাবল লাইন ডুয়েল গেজের এই রেল সেতু হবে দেশের বৃহত্তম ডেডিকেটেড রেল সেতু। সেতুটিতে ৫০টি পিলার ও ৩৭টি স্প্যান থাকবে।

এই স্প্যানের মধ্যে ৩৬টি নির্মাণ করা হবে ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারে। বাকি ১টি নির্মাণ করা হবে বাংলাদেশে। সেতুটি জাপানি প্রযুক্তিতে, এন্টিওয়েদারিং স্টিল দিয়ে তৈরি হবে। যাতে কখনোই রং করতে না হয়। এতে সেতু রক্ষণাবেক্ষণ খরচও তেমন লাগবে না।

নতুন এ সেতুর উপর দিয়ে ব্রডগেজ লাইনে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার এবং মিটার গেজ লাইনে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে রেল চলতে পারবে।বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে যেখানে ৩৮টি রেল চলাচল করতে পারে সেখানে বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু নির্মিত হলে প্রতিদিন ৬৮টি রেল চলাচল করতে পারবে।

রেল সেতুটির বৈশিষ্ট্য

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবীর জানিয়েছেন, নতুন রেল সেতু হলে নতুন রুট চালু করা হবে। বর্তমানে যে রেল সেতুগুলো রয়েছে তাতে একটি করে লাইন রয়েছে। এই সেতুটিতে দুটি রেললাইন বসবে। যার ফলে কোনো ট্রেনকে সেতু পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। একসঙ্গে দুটো ট্রেন দুদিকে চলে যেতে পারবে।

ঘণ্টায় সর্বচ্চো ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারে বঙ্গবন্ধু সেতুতে । আবার সেতুটিতে ঘণ্টায় সর্বচ্চো ১২০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলতে পারবে।

এটির ওপর দিয়ে যেকোনো ওজনের মালবাহী ও যাত্রীবাহী ট্রেন চলতে পারবেন। একাধিক লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালানো যাবে।এই ব্রিজের উপর দিয়ে।তিনি বলেন, সাধারণত সামগ্রী বাহী ট্রেনগুলোকে প্রায়ই দুটি ইঞ্জিন দিয়ে টানতে হয়। বর্তমান ব্রিজের ওপর দিয়ে সেটি সম্ভব হয় না।

ইঞ্জিন মেরামত করার জন্য সেটিকে অন্য আরেকটি ইঞ্জিন দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও বঙ্গবন্ধু সেতুতে নেই। যে কারণে পার্বতীপুরের কারখানায় মেরামতের জন্য ইঞ্জিন নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। এই সেতুটি তৈরি হলে সেটি সম্ভব হবে।

যেভাবে তৈরি হচ্ছে রেল সেতু

সেতুটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমার বলেছেন, এই সেতুটি তৈরিতে যেসব উপকরণ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।

সেটি এখনকার রেল সেতুগুলো থেকে আলাদা হবে। এটি ওয়েদারিং স্টিল দিয়ে তৈরি করার কারনে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রায় শূন্য। এই সেতুটিতে জাপানের একটি প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে ফাউন্ডেশন। যেটা প্রযুক্তি জাপানের বাইরে খুব কম ব্যবহৃত হয়। রেল লাইনগুলো চাকার ঘর্ষণে ক্ষয়ে যাওয়া কমাতে বিশেষ উপকরণ ব্যবহার করা হবে।

তাই লাইনগুলো কম পরিবর্তন হবে। এক লাইন দীর্ঘসময় ধরে কার্যক্ষম থাকবে। ব্রিজের সংযোগস্থলে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে তাতে ব্রিজটির ওজন কম হবে। এই উচ্চ প্রযুক্তি দেশের কোনো রেল সেতুতে নেই বা এখনো তৈরি হয়নি। এই সেতু প্রথম।

আন্তর্জাতিক সংযোগের পরিকল্পনা

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, একটা আলাদা (রেল) সেতু বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ আর্থীক ও সামাজিক উন্নতির পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে সংযুক্ত করবে।

বাংলাদেশ ট্র্যান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। বলে শুনানো হচ্ছে,সেতুটি ভবিষ্যতে সেই সংযোগ তৈরি করতে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই লক্ষ্য নিয়ে রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ চলছে উত্তর সীমান্ত এলাকায়।

Related Articles

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।