রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কোথায়! পরমাণু শক্তি ব্যবহারের তালিকায় নাম লেখালো বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত রাশিয়ার মতো উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে এই শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দার প্রান্তে বাংলাদেশ।
এই পাওয়ার প্লান্ট সম্পূর্ণভাবে উৎপাদনে গেলে বাংলাদেশে বিদ্যুতের ঘাটতি আংশিকভাবে উন্নতি হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ সরকার। বেশি দিন আগের কথা নয় ২০২৩ সালে এপ্রিল, মে এবং জুন মাসে দেশ জুড়ে দেখা দেয় বিদ্যুতের ব্যাপক ঘাটতি। আর এজন্য করতে হয়েছিল লোডশেডিং।
সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন তথ্য থেকে জানা যায়। সে সময় বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ১২ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে। যেখানে গ্রীষ্মকালের সেই সময়ে প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। বাড়তি এই চাহিদার যোগান দিতেই এই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট।
নিউক্লিয়ার চুল্লি এবং পারমাণবিক বোমার মধ্যে পার্থক্য
নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট বা পারমাণবিক চুল্লি শব্দটি শুনলেই অনেকের মধ্যে ভয় থাকতে পারে। অনেকেই এটিকে পারমাণবিক বোমার সঙ্গে একত্রিত করছে।
সঙ্গত কারণে পারমানবিক বোমা এবং চুল্লি একক হলেও মৌলিক কিছু ভিন্নতার কারণে ভয়াবহতা ও কার্যকারিতা ভিন্ন। পারমাণবিক চুল্লি এবং পারমাণবিক বোমা দুটোই নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। অর্থাৎ হাইড্রোজেন ইউরেনিয়ামের পরমাণুকে ভেঙে দিয়ে বেরিয়াম, ক্রিপ্টন ও আরো দুটি নিউটন সহ প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপাদন করে।
পার্থক্য হল পারমাণবিক চুল্লিতে তুলনামূলক দীর্ঘ সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রিত এই বিক্রিয়াটি পরিচালনা করা হয়।অপরদিকে চুল্লির চেয়ে আকারে ছোট বোমায় পুরো প্রক্রিয়াটি অনিয়ন্ত্রিত চেইন রিয়াকশন যা অল্প কিছু সময়ের মধ্যে অনেক বেশি পরিমাণে শক্তি উৎপাদন করে। অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র স্থানে সেকেন্ডেরও কম সময়ে বেশি শক্তি নির্গত হয়। পারমাণবিক বোমায় এই পারমাণবিক কণাগুলো উন্মুক্ত থাকার কারণে এর ভয়াবহতা অনেক বেশি।
চেরনবিল ও ফুকুসিমার পরিণতি
তবে অনেকের মনে চেরনবিল ও ফুকুসিমার মত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্ঘটনা মনে দাগ কাটে। ইন্টারন্যাশনাল এটোমিক এনার্জির তথ্য মতে চেরনবিল প্লান্টের আশেপাশে প্রায় দেড় লাখ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলে দূষণ ছড়িয়ে পড়ে।
এমনকি ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত অঞ্চল পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ফুকুসিমার ক্ষেত্রে পারমাণবিক চুল্লির ৬০০ বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকার দেড় লাখ বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তাহলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকিতে।
বাংলাদেশ পারমাণবিক চুল্লির অবস্থান
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় এই পারমাণবিক চুল্লি ঢাকা থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার নিউক্লিয়ার পাওয়ার কোম্পানি রোসাটমের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে।
এই চুক্তির অধীনে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণসহ কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করবে এই প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সাল থেকে এক হাজার ৬৪৩ জন বিশেষজ্ঞ এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এছাড়াও প্রকল্পটির সার্বিক নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সির তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটোমিক এনার্জি
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটোমিক এনার্জি এজেন্সি হলো একটি আন্ত সরকারি ব্যবস্থা। যা পারমানবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য কাজ করে থাকে। এই সংস্থাটি বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিদর্শন করে কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন সুপারিশ প্রদান করে।
এর মধ্যে এই সংস্থাটির নিরাপত্তা বিধান অনুযায়ী জাতীয় নীতিমালা ও কৌশল প্রণয়ন, কর্মী ও সাধারণ জনগণ এবং পরিবেশের সুরক্ষার জন্য মৌলিক নীতিমালা ও আইনি কাঠামো তৈরি এবং যোগ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পর্যাপ্ত লোকবল তৈরি করা উল্লেখযোগ্য। অর্থাৎ এই সংস্থাটি বলছে শুধু পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ করলেই চলবে না। এই চুল্লির রক্ষণাবেক্ষণ বর্জ্য নিষ্কাশন থেকে শুরু করে নিরাপত্তা ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে কাজ করেছে এই মেগা প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
বাংলাদেশে যেসব উপাদান দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়
পারমাণবিক চুল্লি ছাড়াও গ্যাস, ফার্মেস ওয়েল, কয়লা, ডিজেল, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং আমদানি করার মাধ্যমে বিদ্যুতের যোগান দিয়ে থাকে বাংলাদেশ সরকার। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস থেকে। যা বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের ৪৯% তালিকায় এটিই প্রথম।
৬,১৪১ মেগাওয়াট উৎপাদন করে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ফার্মেস ওয়েল। আর কয়লার মাধ্যমে উৎপাদন করা হয় ৪ হাজার ৮৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। পারমাণবিক চুল্লির দুইটি গ্রিড থেকে জাতীয় গ্রিডে আরো ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত করা হবে।
কেন পারমাণবিক চুল্লির দিকে নজর দিল বাংলাদেশ
PDF এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গ্যাস, কয়লা, সৌর বিদ্যুৎ, ফার্নেস ওয়েল এবং ডিজেল থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ যথাক্রমে ৩.১৩, ১০.৩১, ১৫, ১৬ এবং ২৮ টাকা।
যেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিটে খরচ পড়বে ৪.৩৮ টাকা। শক্তি উৎপাদনে কর্মদক্ষতা বিচার করলে ১২০ গ্যালন তেল, ১৭ হাজার কিউবিক ফিট ক্যাশ, এবং এক টন কয়লা থেকে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় তার সমপরিমাণ শক্তি নির্গত হয় মাত্র এক ইঞ্চি লম্বা ইউরেনিয়াম থেকে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থায়িত্ব
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র মূলত ৬০ বছরের জন্য নির্মাণ করা হয়ে থাকে। যা ৮০ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যায়। অপরদিকে অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গড় আয়ু হয়ে থাকে ১৫ থেকে ২০ বছর।
এছাড়া অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশকে তেল এবং গ্যাস পাশাপাশি কয়লার উপর নির্ভর করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সেপ্টেম্বরের ২২, ২৩ তারিখে মোট ২,৮১৯ মিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে ১,১৩৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয় দেশের সব কয়টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রর পাওয়ার প্লানগুলোতে। তবে ঐ একই সময়ে পাওয়ার প্লানগুলোতে গ্যাসের চাহিদা ছিল ২০,২৪০ মিলিয়ন ঘনফুট।
গ্যাসের এরকম ঘাটতি সচরাচর সব সময় দেখা যায়। তাই এই ঘাটতিকে পূরণ করার জন্য সরকারের এলএনজি ফার্নেস ওয়েল এবং ডিজেল আমদানি করতে হয়। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সী ২০২২ সালের তথ্য মতে বিদ্যুৎ খাতে ৯৭০ মিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দেয় বাংলাদেশ সরকার। আবার বিভিন্ন সময়ে কয়লার ঘাটতি থাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলো বন্ধ হতেও দেখা গিয়েছে।
আবার এমনও দেখা গিয়েছে বিশ্বের প্রতিনিয়ত তেল এবং গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সব কিছুর সমাধান হতে পারে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তবে বাংলাদেশে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও এই চুল্লি নির্মাণের শুরুর দিকের বাজেট ছিল মাত্র ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
পারমাণবিক চুল্লির কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ
পাওয়ার প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতি আঠারো মাসে ১ লাখ ১৩ হাজার কেজি ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন পড়বে। আর এ জন্য খরচ পড়বে ৫২৩.৯০ কোটি টাকা। নির্মাণ ব্যয় তুলনামূলক অনেক বেশি মনে হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটি সার্বিকভাবে অনেক সাশ্রয়ী হবে।
এছাড়াও পারমাণবিক চুল্লিকে তুলনামূলক পরিবেশবান্ধব বলা যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিভিন্ন জ্বালানির ব্যবহার কতটা কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী এ নিয়ে তথ্য প্রকাশ করেছে জার্মান ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জার্মান environment agency। তাদের পরিসংখ্যান মতে প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায় দিক নাইট এবং এন্ড্রোসাইট কয়লা থেকে কার্বন মিশ্রণের পরিমাণ যথাক্রমে ১,০৩৪ এবং ৮৬৪ গ্রাম।
প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে কার্বন নিঃসরণ ৪৪২ গ্রাম, আর নিউক্লিয়ার জ্বালানি থেকে নিঃসরণ প্রায় ১১৭ গ্রাম। তবে পারমাণবিক চুল্লি থেকে কার্বন নিঃসরণের এই মাত্রা সোলার প্যানেল, জলবিদ্যুৎ এবং উইন মিল থেকে বেশি। সোলার প্যানেল, জলবিদ্যুৎ এবং উইন মিল থেকে প্রতি ঘন্টায় যথাক্রমে ৩,৩৯ এবং ৪ গ্রাম কার্বন নিঃসরিত হয়ে থাকে।
বিভিন্ন সংস্থানের পরিসংখ্যান
পরিবেশ, জলবায়ু এবং স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাবকে আর্থিক মূল্যে তুলনা করলে প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং কয়লা থেকে ক্ষতির পরিমাণ যথাক্রমে ৩১ এবং ৭৬ সেন্ট ইউরো। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের ক্ষেত্রে এটি ৭৬ সেন্ট এর বেশি।
এই তথ্যগুলো প্রকাশ করেছে জার্মান ভিত্তিক গবেষণা সংস্থান ফ্রন্ট হপার সোলার অ্যাসিস্ট্যান্ট, জার্মান এনভারমেন্ট এজেন্সি এবং জার্মান ইনস্টিটিউট অফ ইকোনোমিক রিসার্চ।
২০২১ সালে বাংলাদেশে মোট কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ছিল ৯৩.১৮ মিলিয়ন টন। এতে গ্যাস, তেল এবং কয়লার পরিমাণ যথাক্রমে ৫৮.৭৪, ১৮.০৬ এবং ১৪.৮৫মিলিয়ন টন। অপরদিকে শক্তি এবং তাপ উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ৩৯.৫ যার মিলিয়ন টন।
শুধুমাত্র বিদ্যুতের ঘাটতির জন্য বাংলাদেশকে প্রতিবছর ৩.৩ বিলিয়ন ডলার লোকসান গুনতে হয়। দেশে বর্তমানে যে অবকাঠামো উন্নয়ন চলছে তার সুফল ভোগ করতে হলেও প্রয়োজন পড়বে তুলনামূলক দীর্ঘমেয়াদী ও সাশ্রয়ী বিদ্যুতের যোগান। এই দিক থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বন্ধুরা রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আজকের এই পোষ্টটি আপনাদের কাছে কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে জানিয়ে দিন। আর বাংলাদেশের এরকম মেঘা প্রজেক্ট গুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে আমাদের পরবর্তী পোস্টগুলো ফলো করুন ধন্যবাদ।