খেলাধুলা

IPL এ শিরোপা না জিতেও ফ্রাঞ্চাইজিগুলো যেভাবে লাভবান হয়

আইপিএলে দলগুলো কিভাবে আয় করে

আইপিএলে দলগুলো কিভাবে আয় করে! বন্ধুরা শুরু হয়ে গেছে আইপিএলের দামামা। প্রতি বছর এই আইপিএলকে কেন্দ্র করে পুরো বিশ্বে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয়ে থাকে।

আর এটি কিভাবে? এটি মূলত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ আইপিএল এর ভক্তদের দ্বারা এই বাণিজ্য বিসিসিআই করে থাকে। এছাড়া আইপিএল এ আমরা প্রায়ই দেখে থাকি ফ্রাঞ্চাইজিগুলো কোটি কোটি টাকা দিয়ে তাদের দলে নামিদামি খেলোয়াড়দের ভিরিয়ে থাকে।

এমনকি ২০২৪ আইপিএল এর জন্য কলকাতা নাইট রাইডার্স ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে ২৪ কোটি ৭৫ লাখ রুপিতে অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার মিচেল স্টার্ককে দলে ভিরিয়েছে। যা আইপিএল ইতিহাসে এক বিরল রেকর্ড। এছাড়া আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো আইপিএলে প্রথম দিকে ৮টি দল অংশগ্রহণ করলেও এখনো অব্দি মোট ১০ টি দল আইপিএলে খেলে আসছে।

সর্বশেষ ২টি দল লাখনৌ সুপার জায়ান্ট ও গুজরাট টাইটানস আইপিএলে অংশগ্রহণ করছে। আর এই দুটি দল আইপিএলে অংশগ্রহণ করার বছরে তাদের দল সাজানোর জন্য বা দলে তারকা ক্রিকেটার ভেড়ানোর জন্য খরচ করেছিল ২৩৩.৫৯ কোটি রুপি এবং ২২৬.৫৪ কোটি রুপি।

এছাড়াও দলটির মালিকেরা দল কেনা বাবদ খরচ করেছে ৭ হাজার ৯০ কোটি রুপি এবং ৫ হাজার ৫ শত ২৫ কোটি রুপি। কি মনে হচ্ছে দলগুলো বা দলের মালিক গুলো কি কারণে প্রতিবার আইপিএলে এত কোটি কোটি টাকা খরচ করে। এটি কি শুধুই ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিশাল বাণিজ্য। আজকে আমরা জানবো আইপিএলে বিনিয়োগ করা দলগুলো কিভাবে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বিনিয়োগের দ্বিগুণ টাকা আয় করে থাকে সে সম্পর্কে।

আইপিএলের ফ্রাঞ্চাইজি গুলো কেন এত বিপুল বিনিয়োগ করে

আমরা হয়তো সকলেই জানি আইপিএলের প্রাইজ মানি মাত্র ২০ কোটি রুপি। যেখানে একটি খেলোয়াড়কে কিনতে খরচ করা হয় ২৪ কোটি রুপি।

তাহলে কি কারণে দলগুলো এই সামান্য প্রাইস মানির কারণে এত বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে থাকে। এটা কি শুধুই সম্মান অর্জনের জন্য, নাকি যা বিনিয়োগ করা হয়েছে তার দ্বিগুণের বেশি আয় করার জন্য। আইপিএলে প্রতিবছর শুধুমাত্র যে বিসিসিআই আয় করে থাকে এমনটি নয়।

আইপিএলে প্রতিবছর দলগুলোও বিপুল পরিমাণ আয় করে।আর এত বিপুল পরিমাণ আয় ভারতের জিডিপিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইপিএলে দলগুলো মূলত তিনটি উপায়ে আয় করে থাকে। যেমন ১. কেন্দ্রীয় রাজস্ব ২. টিম স্পন্সরশিপ ৩. টিকেট বিক্রি।

১. কেন্দ্রীয় রাজস্ব

যেহেতু আইপিএলের আয়োজক ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বা বিসিসিআই। তাই আইপিএল এ যত আয় হয়ে থাকে তার সম্পূর্ণ মালিক বিসিসিআই। আর এ বিসিসিআই সম্পূর্ণ আইপিএল থাকে আয় হওয়ার একটা অংশ দল গুলোর মধ্যে ভাগ করে দেয়। যাকে কেন্দ্রীয় রাজস্ব আয় বলে। আর এই কেন্দ্রীয় রাজস্ব আয়ের মধ্যে দুটি ভাগ রয়েছে যেমন ১/ সম্প্রচার স্বত্ব, ২/ টাইটেল স্পন্সরশিপ।

  • সম্প্রচার স্বত্ব

আইপিএল যখন ২০০৮ সালে শুরু করা হয় তখন ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এর সম্প্রচার স্বত্ব কিনে নেয় সনি চ্যানেল। আর এ জন্য তাদেরকে গুনতে হয়েছিল ৮ হাজার কোটি রুপি। এরপরে ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল এই পাঁচ বছরের জন্য সম্প্রচার স্বত্ব কিনে নেয় স্টার স্পোর্টস নেটওয়ার্ক।

এজন্য তাদেরকে গুনতে হয় ১৬ হাজার কোটি রুপি। সর্বশেষ ২০২৩ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত সম্প্রচার স্বত্ব কিনে নেয় ডিজনি স্টার, ভায়াকম১৮ এবং টাইমস ইন্টারনেট। আর এই ৫ বছরের জন্য তাদেরকে গুনতে হয় ৪৮ হাজার ৩৯০ কোটি রুপি। যা আইপিএলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বেশি দামে বিক্রি হওয়া সম্প্রচার স্বত্ব।

আইপিএলের কাঠামো অনুযায়ী বলা আছে সম্প্রচার স্বত্বের সম্পূর্ণ অর্থকে দুই ভাগে ভাগ করে এক ভাগ বিসিসিআই রেখে দেবে আরেকটি ভাগ অন্যান্য দল গুলোর মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হবে। তবে এখানে একটি বিষয় হলো যেই দলগুলো সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে তাদেরকে তুলনামূলক বেশি এবং যারা সর্বশেষ ফাইনালে অংশগ্রহণ করবে তাদেরকে তুলনামূলক আরেকটু বেশি অর্থ প্রদান করবে বিসিসিআই।

এরপরে পয়েন্ট টেবিল অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে বাকি দলগুলোকে সম্প্রচার সত্যের বাকি টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়। আর এখান থেকেই দলগুলো একটি বিরাট অংশ আয় করে থাকে।

  • টাইটেল স্পন্সরশিপ

বিসিসিআই টুর্নামেন্টের নামটাও বিক্রি করে। ফলে আইপিএলের আগে ঐ স্পন্সরশিপ প্রতিষ্ঠানের নাম জুড়ে দেয়। যেমন ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আইপিএল কে ডাকা হতো ডিএলএফ আইপিএল নামে। এরপরে পেপসি আইপিএল, ভিভো আইপিএল, ড্রিম ইলেভেন আইপিএল, হয়ে এখন ‘টাটা আইপিএল নামে ডাকা হয়।

আর এই টাইটেল স্পন্সর করার জন্য বিভিন্ন ধরনের নামিদামি প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতা করে থাকে। যেমন বর্তমানে টাটা কোম্পানি টাইটেল স্পন্সারের জন্য প্রতিবছর বিসিসিআইকে ৩৩০ রুপি দিয়ে থাকে। এছাড়াও বিসিসিআই স্ট্র‍্যাটেজিক টাইম আউট স্পন্সর, পাওয়ার প্লে স্পন্সর সহ বেশ কিছু আয় করে থাকে যেগুলো কেন্দ্রীয় রাজ্যের অধীনে।

আর এই আয় গুলোতে বিসিসিআই এবং ফ্রাঞ্চাইজি গুলোর সমান ভাগ রয়েছে। আর এসব স্পন্সরশিপ থেকেই দলগুলো প্রতি মৌসুমে গড়ে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগের বেশি আয় করে থাকে।

২. টিম স্পন্সরশিপ

প্রতি মৌসুমে আইপিএলের জন্য দলগুলো গড়ে প্রায় ২০০ কোটি রুপির বেশি খরচ করে থাকে। আর এ খরচ গুলো মূলত  তারা দলে খেলোয়াড় ভিড়ানো, খেলোয়াড়দের যাতায়াত, কোচ, টিম হোটেলে অবস্থান, খাওয়া-দাওয়া সহ অন্যান্য খাতে ব্যয় করে। কেন্দ্রীয় রাজস্বের বাইরেও দলগুলো তাদের নিজস্ব স্পন্সরশিপের  মাধ্যমে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে।

যেমন আমরা আইপিএলে প্রতিটি দলের জার্সিতে গরে ৮টি করে ব্রান্ড স্পন্সর দেখতে পাই। আর এই ব্র্যান্ডগুলো জার্সিতে, হেলমেটে, ব্যাটে দেখা যায়। ব্র্যান্ডগুলো কোথায় স্থান পাবে তার উপর ভিত্তি করে দলের সঙ্গে চুক্তি করা হয়।

এছাড়াও স্বাগতিক দল হিসেবে যে মাঠে ম্যাচটি আয়োজন করা হয় সেই মাঠের সীমানা দড়ি থেকে শুরু করে সমস্ত স্থানে যে সকল ব্রান্ড স্পন্সরশিপ দেখা যায় সেগুলো তাদের নিজস্ব আয়। এখানে বিসিসিআইকে কোন অর্থ প্রদান করতে হয় না। আর এর মাধ্যমে দলগুলো প্রতি মৌসুমে গড়ে ২০ থেকে ৩০ ভাগ আয় করে থাকে।

৩. টিকেট বিক্রি

আইপিএলের ম্যাচগুলোতে প্রচুর পরিমাণে দর্শক হয়ে থাকে। আর এসব দর্শকরা মাঠে খেলা দেখার জন্য মূলত অর্থের বিনিময়ে প্রবেশ করে। যাকে আমরা টিকিটের বিনিময়ে খেলা দেখা বলে থাকি। ধরুন  ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে আজকের আইপিএল এর একটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স ও অন্য একটি দল মোকাবেলা করবে।

এক্ষেত্রে স্টুডিয়ামের যতগুলো টিকিট বিক্রি হবে তার ৮০ শতাংশ পাবে মুম্বাই ইন্ডিয়ান। কেননা আইপিএল এখন হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে মাধ্যমে হয়ে থাকে। অর্থাৎ হোম গ্রাউন্ডে কোন দল খেলে থাকলে সেই দল স্টুডিয়ামের ৮০ শতাংশ টিকিটের মূল্য পাবে। আর বাকি ২০ শতাংশ ঐ রাজ্যের ক্রিকেট এসোসিয়েশনের কাছে চলে যাবে। আর প্রতি মৌসুমে টিকিট বিক্রি থেকে দলগুলো ১০ ভাগ আয় করে থাকে।

আইপিএল এর দলগুলো মূলত এই তিনটি উপায়ে সবচেয়ে বেশি আয় করে থাকে। এর বাইরেও অল্প কিছু সংখ্যক আয় আইপিএলের দলগুল করে থাকে। যেমন,

  • মার্চেন্ডাইজ বিক্রি

আইপিএলের প্রতিটি দলই তাদের মূল জার্সির রেপ্লিকা বিক্রি করে সমর্থকদের জন্য। আর এসব রেপ্লিকার মধ্যে রয়েছে ঘড়ি, রিস্টব্যান্ড, মোবাইলের কাভার, টি-শার্ট সহ বিভিন্ন সামগ্রী।যেখান থেকে দলগুলো তাদের মোট আয়ের ৫ শতাংশ আয় করে থাকে।

  • প্রাইজ মানি

আমরা আগেই জেনেছি আইপিএলের প্রাইজমানি ২০ কোটি রুপি। যে দল আইপিএলের শিরোপা জিতবে ঐ দলটি এই টাকাকে আবার দুই ভাগে ভাগ করে একটি নিজের কাছে রেখে দিবে আরেকটি ভাগ খেলোয়ার এবং প্রশিক্ষকদের মাঝে বন্টন করে দেবে।

  • নিজস্ব ব্রান্ডের প্রচারণা

বেশিরভাগ আইপিএল ফ্রাঞ্চাইজি গুলোর মালিক হয় অনেক বড় শিল্পপতি, না হয় কোন বড় কোম্পানির মালিক অথবা বৃহৎ ব্যবসায়ী। আর মালিকগুলো তাদের পণ্যের প্রচারের জন্য নিজের ফ্রাঞ্চাইজিকে ব্যবহার করে থাকে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে দলে ভিড়ানো খেলোয়াড়দের কেউ ব্যবহার করে। আর এখান থেকেও দলের মালিকরা অনেক বেশি লাভবান হয়।

বন্ধুরা ২০০৮ সালের পর থেকে আইপিএল এত বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে যে, যেখানে গতবছর ১০ সেকেন্ডের একটি বিজ্ঞাপন স্লটের জন্য খরচ করতে হয়েছিল ১৫ লাখ রুপি। ভাবা যায়, এ থেকে বুঝা যায় আইপিএলের জনপ্রিয়তা সারা বিশ্বে কত বেশি। আমরা এরকম বিজ্ঞাপন স্লটের দাম দেখে থাকি যখন ভারত এবং পাকিস্তান মুখোমুখি হয়। কিন্তু ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে এটিই প্রথম যেখানে ১০ সেকেন্ডের জন্য এত বেশি পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয়।

Related Articles

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।