রাজনীতি

ফিলিস্তিন ভূখণ্ড নিয়ে পশ্চিমাদের কেন এত আগ্রহ

ফিলিস্তিনের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

ফিলিস্তিনের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব! ফিলিস্তিন নামক এক ভূখণ্ড নিয়ে কতই না লড়াই। যুগের পর যুগ এই অঞ্চলটি কার দখলে যাবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ সবসময় গুরুত্বের ছিল। কিন্তু কেন প্রশ্ন জাগতেই পারে? পৃথিবীতে এত ভূখণ্ড থাকতে ফিলিস্তিন নিয়ে কেন এত লড়াই।

কেন জায়ান্ট বাদিরা ইহুদি নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া। এ লড়াই কি কেবলে ধর্মীয় নাকি এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সমীকরণ। এসব প্রশ্নের উত্তর জানাবো এবারের ভূরাজনৈতিক পর্বে। তাহলে চলুন শুরু করি আজকের পোস্টটি।

ভূরাজনীতি

১৫১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ অংশসহ বর্তমান ইসরাইল অটোমান সম্রাজ্যের অংশ ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নাটকীয় ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির পট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ফিলিস্তিন বৃটেনের অধীনে চলে যা।

১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন অটোমান সম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সে বছর নভেম্বরে তুরস্ক সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। সেসময় ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনে সহায়তার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরই ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড জেমস এই বিষয়টি জানিয়ে ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রফ চাইল্ড কে চিঠি লেখেন। যে চিঠি বেলফোর্ড ডিক্লারেশন নামে পরিচিত।

আরবরা বেলফোর্ড ডিক্লারেশনের তীব্র বিরোধিতা করে। অবশ্য ১৮৯৭ সাল থেকে ইহুদিরা চেয়েছিল নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। উনিশ শতকের শেষ দিকে জায়ান বাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। তাদের চোখ পরে আরব ভূখণ্ডে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ইহুদীরা ফিলিস্তিনে এসে বাস করতে শুরু করে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে  ইহুদিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্তের সিদ্ধান্ত নেয়া জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য অন্যটি আরবদের। আরবরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয় না।

জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্ত খারিস করে দেয় তারা। ১৯৪৮ সালে ১৪ই মে ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনের মেন্ডেট ছেড়ে দেয়। ঐ দিনে ইহুদী নেতারা ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। পরদিন আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। তাদের একটা বড় অংশ দখল করে নেয় ইসরাইল।

এতো জায়ানবাদী প্রকল্পের সবে শুরু। ১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে আবারো যুদ্ধ বাঁধে ইজরাইলিদের। নয় দিনব্যাপী যুদ্ধে আবারও আরবরা পরাজিত হয়। মিশরের কাছ থেকে দখল করা গাজা ও সিনাই উপত্যকা জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিতির ও পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার কাছ থেকে গোলার মালভূমি।

এ সময় প্রায় তিন লাখের বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচুত হয়। এখনো নিজ দেশে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে অসংখ্য ফিলিস্তিনি। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখনো দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামি সংগঠনগুলো। আর ফিলিস্তিন ভূখণ্ড নিয়ে প্রতিনিয়ত ভূরাজনৈতিক খেলায় মেতেছে প্রভাবশালী দেশগুলো।

 ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ভৌগোলিকভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

ভৌগোলিক ও কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফিলিস্তিন অঞ্চল। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের সীমানা বিন্দুতে অবস্থিত ফিলিস্তিন। অর্থনীতি, রাজনীতি সহ নানা দিক থেকে অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করছে;।

ইহুদি কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা নাহুম গোল্ডম্যান বলেছিলেন সেজন্যই এই ভূখণ্ডকে বেছে নেওয়া। ফিলিস্তিনের পূর্বে রয়েছে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, জর্ডান ও সৌদি আরব পশ্চিমে মিশর। এই পুরো অঞ্চল তেল সমৃদ্ধ। ফিলিস্তিনের দক্ষিণ অংশ আঁকাবা উপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। আঁকাবা উপসাগরের সামনে লোহিত সাগর।

ইউরোপ ও এশিয়ার তেল ভিত্তিক জাহাজগুলো প্রথমে লোহিত সাগরে আসে এরপর সুয়েজ খাল পার হয়ে ভূমধ্যসাগরে যায়। ইউরোপ ও এশিয়ার বাণিজ্যের মেরুদন্ড সুয়েজ খাল থেকে ফিলিস্তিন অঞ্চলের দূরত্ব ২০০ কিলোমিটারের বেশি। সুয়েজ খাল দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যের ১২ শতাংশ বেশি পণ্য পরিবহন হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই সুয়েজ খালটির উপর নজর রাখার সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে ফিলিস্তিন।

ধর্মীয় দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ

ধর্মীয় দিক থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের গুরুত্ব অনেক। এখানেই পবিত্র শহর জেরুজালেম অবস্থিত। যেখানে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মের পবিত্র স্থাপনা মসজিদ আল-আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস। এই জায়গাটি মক্কা ও মদিনার পর যা মুসলমানদের কাছে তৃতীয় পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত।

অন্যদিকে ইহুদিদের দাবি এখানে অবস্থিত তাদের পবিত্র ভূমি টেম্পাল মাউন্ট বা ঈশ্বরের ঘর। খ্রিস্টানরা মনে করেন এই স্থানেই  যিশু খ্রীষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। এ কারণে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমান তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্রবলে বিবেচিত জেরুজালেম। তাই শহরটি নিয়ে দ্বন্দ্বেরও শেষ নেই। দিনের পর দিন নিজ ভূখন্ডেই ইহুদিদের নির্যাতনের শিকার ফিলিস্তিনিরা। বিশ্লেষকদের মতে এই দ্বন্দ্ব টিকিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলোর স্বার্থ ও মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব।

ভুরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে ফিলিস্তিনিরা যতটা গুরুত্বের তার চেয়েও বেশি গুরুত্বের ফিলিস্তিন ভূখণ্ড। ফিলিস্তিনের পাশাপাশি ইরাক, মিশর, সৌদি আরব, জর্ডান ও সিরিয়া ভূখণ্ড দখল করে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করাই এখন মূল লক্ষ্য বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আরব রাষ্ট্রগুলোকে ভেঙে না ফেলা পর্যন্ত তারা নিরাপদ নয়। ফিলিস্তিনে ইসরাইল যত বেশি শক্তিশালী হবে মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের বলয় আরো জোরালো হবে। আর তাই সম্প্রতি অধিকৃত পশ্চিম তীরের ইসরাইলিরা নিরীহ ফিলিস্তিনের উপর ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলা চালালেও নিশ্চুপ পশ্চিমা বিশ্ব।

বন্ধুরা ইসরাইল ভূখণ্ড নিয়ে পশ্চিমাদের কর্মকাণ্ড আপনাদের কেমন লাগে তা আমাদের কমেন্ট বক্সে জানিয়ে দিন। ইসরাইল ভূখণ্ডের মত আফগানিস্তান ও সিরিয়ার পরিণতি জানতে আমাদের সাইটটি ফলো করে সঙ্গেই থাকুন ধন্যবাদ।

Related Articles

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।