রাজনীতি

কিভাবে টাকা ছাপানো হয় আর টাকা ছাপাতে কি কি লাগে

টাকা তৈরির নিয়ম! পণ্য বা সেবা আদান প্রদান বা ঋণ পরিশোধের স্বীকৃত মাধ্যম হলো মুদ্রা। যা মূল্যের পরিমাপক ও সঞ্চয়ের বাহন হিসেবে কাজ করে।

টাকা তৈরির নিয়ম

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুরে রয়েছে মুদ্রা। কখনো কি ভেবে দেখেছেন কতটা নিরাপত্তা বলয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বের এই দামি বস্তুটি তৈরি করা হয়। মুদ্রা তৈরি প্রক্রিয়া মূলত ডিজাইনের পর্যায় থেকে শুরু হয়। নোটগুলি অত্যান্ত প্রতিভাবান শিল্পী এবং ডিজাইনারদের হাতে ডিজাইন করা হয়। খুদাইকারীরা হাত দিয়ে নরম স্টিলের উপর মাস্টার ডাইকাটে। প্রতিটি ছাপানো মুদ্রাতেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানের স্বাক্ষর মুদ্রিত থাকে। এই স্বাক্ষর নরম স্টিলের উপর ক্ষুদাই করে করা হয়। স্বাক্ষরকারী পরিবর্তিত হলে নতুন ছাপানো মুদ্রাতেও সেই স্বাক্ষর খোদাই করে ছাপানো হয়। একবার মাস্টার ডাই প্লেটটি হয়ে গেলে এটি যাচাইয়ের জন্য উত্তপ্ত করে একটি পাতলা প্লাস্টিকের সিটে চাপানো হয়।

যাতে সম্পূর্ণ নকশার একটি ছাপ পাওয়া যায়। তারপর ডাইটি স্টোরেজে রাখা হয়। প্লাস্টিক অল্ট্র  ব্যবহার করে মাস্টার প্রিন্ডিং প্লেট তৈরি করা হয়। যা পরবর্তীতে মুদ্রা ছাপানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন দেশে মুদ্রার নকশার জন্য আলাদা প্রক্রিয়া থাকে। যার নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উপাদান যোগ করা হয়।

আন্তর্জাতিক তৈরীর বৈশিষ্ট্য

কারেন্সি নোটগুলো সাধারণ কাগজ থেকে তৈরি হয় না। সুতার কাগজ দিয়ে তৈরি করা হয় নোট গুল। সুতির বিশেষ এই কাগজ তৈরীর অন্যতম কাঁচামাল তুলা। নোট তৈরির সময় তুলাতে পানির পরিবর্তে জিলেটিন অ্যাড্রেসিপ সলিউশন মিশানো হয়। যাতে কাগজটি আরো স্থিতি স্থাপক এবং টেকসই হয় ফলে নোট সহজে ছিড়ে যায় না। কাগজের তৈরি এই মুদ্রা কে জাল বা নকল হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য এতে সুরক্ষা যোগ করা হয়।

 সুরক্ষা যোগ হল মুদ্রাতে এক ধরনের নিরাপত্তার থ্রেট জুড়ে দেওয়া। নিরাপত্তা থ্রেট হল ফিতার মধ্যে একটি অংশ যা কাগজের মুদ্রায় খুব সাধারন ভাবে দেখা যায়। সাধারণত এটি আরাআড়ি মুদ্রার একপাশে লম্বালম্বি ভাবে বুননের মত থাকে। তাই একদিক থেকে দেখা গেলে থ্রেটটিকে বিচ্ছিন্ন দেখা যায়। কিন্তু আলোর বিপরীতে ধরলে অবিচ্ছিন্ন রেখা দেখা যায়। এই নিরাপত্তা থ্রেট গুলি ধাতব বা প্লাস্টিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে এবং বিভিন্ন প্রস্থ ও রঙের হয়ে থাকে। থ্রেট গুলিতে কখনো কখনো মাইক্রো প্রিন্টিংও থাকে। ছাপানো মুদ্রায় নিরাপত্তা থ্রেট এবং ওয়াটার মার্ক সবচেয়ে সাধারণ বৈশিষ্ট্য যা সাধারণ মানুষকে আসল মুদ্রা চিনতে সাহায্য করে।

ইন্টিলিও প্রিন্টিং

এরপর শুরু হয় ছাপার কাজ। প্রথম ধাপে কাগজের উপর সুরক্ষা সুতা, মনোগ্রাম, জলছাপ এগুলো ছাপানো হয়। এরপর চূড়ান্ত ছাপ এবং নাম্বারিং এর জন্য চলে দ্বিতীয় ধাপে ছাপার কাজ। এই ধাপে ৮ টন ওজনের চাপ দিয়ে প্রতিটি নোটে কালি বসানো হয়। এ ধরনের ছাপানোকে বলে  ইন্টিলিও প্রিন্টিং। এই ছাপ হাতেস্পর্শ করলেই বোঝা যায়। আর এই ছাপের মাধ্যমেই চূড়ান্ত হয় প্রতিটি নোট সিট। সিটগুলো ফাইনাল চেকিং এর পর গন্তব্য কাটিং মেশিনে। সেখান থেকে নির্দিষ্ট মাপে কেটে নোট সিট থেকে মুদ্রা গুলো আলাদা করা হয়। পরে পৃথক পৃথক নোটগুলিকে আলাদা আলাদা বান্ডিল করা হয়।

বাংলাদেশের টাকা ছাপানোর নিয়ম

বাংলাদেশে টাকা ছাপানোর কাজটি হয় টাকশালে। টাকশালের প্রতিষ্ঠানিক নাম দা সিকিউরিটি প্রিন্টিং কমিউনিকেশন লিমিটেড। ১৯৮৯ সালে প্রায় ৬৬ একর জায়গা নিয়ে বাংলাদেশের টাকা ছাপানো এই প্রতিষ্ঠানটি গাজীপুরে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। টাকা ছাপানোর ধাপ গুলো অন্যান্য দেশের মুদ্রা ছাপানোর মতোই খুবই গোপনীয়। টাকা ছাপানোর জন্য প্রায় ১২ টি ধাপ পার হতে হয়। ছাপানোর কারখানার অভ্যন্তরে সব কর্মচারীর মোবাইল ফোন কিংবা যেকোনো রকমের ডিভাইস নেওয়া নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে টাকা ছাপানোর বিশেষ কাগজ আসে সুইজারল্যান্ড থেকে। যার প্রতি বর্গমিটারের ওজন ৮০ থেকে ৯০ গ্রাম। সাধারনত এই কাগজগুলো প্রায় দুই বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। এই কাগজে জিলেটিন বা পলিথিন অ্যালকোহল যোগ করা হয় বলে এটি বেশ টেকসই হয়। ফেরো ম্যাগনেটিক কাগজ ব্যবহার করা হয় নিরাপত্তার জন্য। তবে নাইলন এবং অন্যান্য উপাদানও থাকে। টাকাতে কি রং ব্যবহার করা হয় তা নিরাপত্তার জন্য গোপন রাখা হয়।

টাকা ছাপানোর নিয়ম

দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন লিমিটেড ইচ্ছা করলেই যত খুশি টাকা ছাপাতে পারে না। টাকা ছাপাতে হলে বাংলাদেশের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে এক বছরের চাহিদা পত্র লিখিতভাবে পেতে হয় টাকশালকে। এরপর টাকশালের পরিকল্পনা বিভাগ টাকার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ, কালি ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে। পরে বিদেশি ক্রয় বিভাগ আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করে। দরপত্রের কার্যক্রম শেষ করার পর উপকরণ গুলি নিজস্ব পরীক্ষাগারে গুনগত মান যাচাই করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে বিভিন্ন প্রক্রিয়া মেনে চলে টাকা ছাপানোর কাজ। পরে ছাপানো টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন শাখায় হস্তান্তর করা হয়।

দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন লিমিটেড টাকা ছাপানোর উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তা সামগ্রী এই প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহ করে থাকে। যেমন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এর সঞ্চয়পত্র নন জুডিশিয়াল স্টাপ, রাজস্ব স্টাপ, স্মারক ডাক টিকিট, খাম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের টেক্স লেভেল, ব্যাংকের চেক বই, রাইস বন্ড, জিএসপির ফ্রম শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার নম্বর পত্র ও সনদপত্র ইত্যাদি। এছাড়া কোনো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে তাদের শিক্ষা সনদ ছাপানোর কাজও করে থাকে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি।

Related Articles

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।