তথ্য ও প্রযুক্তি

নভোচারীরা কিভাবে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসে

মহাকাশ স্টেশনের কাজ কি

মহাকাশ স্টেশনের কাজ কি! স্পেসে যাওয়া আসার প্রতিটি সেকেন্ড উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকে নভোচারী ও কন্ট্রোল রুমের বিজ্ঞানীরা। কারণ একটু সামান্য ভুল বা যান্ত্রিক ত্রুটি হলে স্পেসেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মারা যাবেন নভোচারীরা। ২০০৩ সালে এমনই একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা দেখতে পায় পুরো বিশ্ব।

স্পেস সাটল উৎক্ষেপণের পর ডানার বাম দিকে একটি ছোট গর্ত দেখতে পায় বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা প্রাথমিক অবস্থায় গর্তটিকে সেরকম গুরুত্ব দেয়নি। ফলের স্পেসশিপে অবস্থিত নভচারীদেরকে বিষয়টি অবগত করেনি। কেননা মহাকাশযানের ডানায় ছিদ্র হওয়ার ঘটনা নাসার কাছে নতুন কোন বিষয় ছিল না। এর আগে বহু মিশনে মাহাআকাশযানের ডানায় অনেকবার এরকম ছিদ্র দেখাগেছে।

আবার মহাশূন্যে গিয়ে নভোচারীরা রিপেয়ারিং করে নিয়েছে। স্পেস শাটল ১৫ দিন মহাকাশে থাকার পর যখন পৃথিবীর কক্ষপথের এটমস ফেয়ারে প্রচন্ড গতিতে ঘন্টায় প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার গতিতে প্রবেশ করে তখন বাতাসের সঙ্গে প্রবল ঘর্ষণে তিন হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা উৎপন্ন হয়।

আর এত গরম বাতাস সেই ছিদ্র দিয়ে ভেতরে ঢুকতে থাকে। যার ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নভোচারীরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ইঞ্জিন এর সকল কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আর চোখের পলকেই স্পেস শাটল আগুনের গোলায় পরিণত হয় এবং সাত জন মহাকাশচারী মহাকাশেই মিশে যায়। মহাকাশচারীদের পৃথিবীতে আসার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন।

কিভাবে এই মিশন পরিচালিত হয় আজকে আমরা এই পোস্টের মাধ্যমে আপনাদেরকে বিস্তারিতভাবে জানানোর চেষ্টা করব। তাহলে চলুন জেনে নেই মহাকাশ থেকে কিভাবে পৃথিবীতে অবতরণ করা হয় সে সম্পর্কে।

ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় যে বাহনগুল

ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে সব সময় তিন থেকে ছয় জন নবচারী অবস্থান করে। একজন নভোচারী মহাকাশ স্টেশনে প্রায় ছয় মাসের মত অবস্থান করে থাকেন। ফলে স্পেস স্টেশনে নভোচারীদের আসা যাওয়া এভাবেই চলতে থাকে।

এখন পর্যন্ত মহাকাশ ষ্টেশনে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে   রাশিয়ান যান সয়ুজ। যেটি ১৯৬৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৪০ বার ৩৭৫ জন নভোচারীকে পৃথিবীতে সফলভাবে নিয়ে এসেছে। এখন পর্যন্ত রাশিয়ান এই যানটি ব্যবহার হয়ে আসছে। এছাড়াও ১৯৮১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত স্পেস সাটল ব্যাবহার করা হয়েছে। স্পেস সাটল এখন পর্যন্ত ১৩৩ বার নভোচারীকে পৃথিবীতে সফলভাবে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।

স্পেস সাটল প্রথম স্পেসক্রাফট যা রানওয়েতে নামতে পারত। অনেক বেশি খরচের কারণে ২০১১ সালে এই যানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেননা প্রতিবার নভোচারীদেরকে নিয়ে আসতে খরচ হতো প্রায় এক থেকে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সাল থেকে ইলন মার্কসের ড্রাগন টু ক্যাপসুল ব্যবহার হয়ে আসছে। ড্রাগন টু ক্যাপসুল খুবই কম খরচে নবচারীদের ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। এটার খরচ প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার যা স্পেস সাটলের অর্ধেকেরও কম।

 ইলন মাক্সের গবেষণা সংস্থা অনবরত গবেষণা করে যাচ্ছে কিভাবে এই খরচ আরো কমিয়ে আনা যায়। ইলন মাক্স বলেছেন তারা মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলারের নিচে খরচ নামিয়ে আনতে পারবে। ড্রাগন টু ক্যাপসুল এখন পর্যন্ত মোট ১০ বার পৃথিবীতে সফল অবতরণ করেছে। যেখানে রাশিয়ার সয়ুজ এবং ড্রাগন ক্যাপসুলের কার্যক্রম একই। তবে স্পেস শাটলের মেকানিজম সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন জেনে নেওয়া যাক কিভাবে এই যানগুলোর মাধ্যমে নভোচারীরা পৃথিবীতে ফিরে আসে।

সয়ুজ

ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। স্টেশনটি ঘণ্টায় প্রায় ২৮ হাজার কিলোমিটার গতিতে গতিশীল অবস্থায় ঘুরতে থাকে এবং প্রতিদিন ৯০ মিনিটে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। স্টেশন থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসতে সর্বোপরি তিন ঘন্টা সময় লাগে। যাত্রাটি শুরু করার আগে ভূপৃষ্ঠে কিছু কার্যক্রম থাকে।

বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর নির্দিষ্ট একটি স্থান ঠিক করে যেখানে নভোচারীরা অবতরণ করবে এবং ঐ জায়গায় সব ধরনের রিস্কিউ টিমের আয়োজন করা হয়ে থাকে। যাতে করে কোন দুর্ঘটনা হলে সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করতে পারে।

ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে থাকা নভোচারীদের আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয় কে কে পৃথিবীতে আসবে এবং তাদেরকে ৭ দিন আগে থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সয়ুজে থাকাকালীন সময়ে কি কি করতে হবে। নভোচারীরা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে থাকা নবচারীদেরকে বিদায় জানিয়ে সয়ুজে  উঠেন তারা।

এরপর বিজ্ঞানীদের সবুজ সংকেত পাওয়ার পর সয়ুজকে ধীরে ধীরে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে আলাদা করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের গতিকে মাথায় রেখে সয়ুজকে প্রতি সেকেন্ডে ১০ থেকে ১৩ সেন্টিমিটার গতিতে আলাদা করা হয়। তিন মিনিটে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে ২০ মিটার সরে আছে সয়ুজ।

এরপর নভোচারীরা ১৫ সেকেন্ডের মত জ্বালানি ফুরিয়ে সয়ুজের গতি বাড়িয়ে দেন বা কমিয়ে দেন। সয়ুজের গতি কমবে না বাড়বে তা নির্ভর করে সয়ুজকে কোন স্থান থেকে বিচ্ছেদ করা হচ্ছে তার উপর।

ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে ছাইটের দিকে আলাদা হলে সয়ুজের গতি কমিয়ে লোয়ার অরবিটে হয়। আবার সয়ুজকে যদি ডগিং পয়েন্ট থেকে আলাদা করা হয় তাহলে ৪০ মিনিট আগে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের অরেন্টেশন পরিবর্তন করা হয়। এরপর সয়ুজ গতি বাড়িয়ে আপার অরবিটে চলে যায়।

ফলে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের সঙ্গে সয়ুজের গতির ভিন্নতা তৈরি হয়। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে আপার বা লোয়ার অরবিটে যাওয়ার মানে হল যাতে করে বাহনটির সঙ্গে ইন্টারনেসনাল স্পেস স্টেশন এর সংঘর্ষ এড়ানো যায়। বাহনটি অরবিট পরিবর্তন করার পর পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে থাকে। এর পরেই সবচেয়ে জটিল এবং কঠিন পরীক্ষা আসে সয়ুজের জন্য তা হলো ডি অরবিটবাল।

এক্ষেত্রে সয়ুজকে তার গতির দিক বরাবর জ্বালানি ফুরাতে থাকে যার ফলে সয়ুজের গতি ক্রমাগত কমতে থাকে। গতি যত কমতে থাকে বাহমনটি তত লোয়ার অরবিটে আসতে থাকে।

এই ডি অরবিট মানের ক্ষেত্রে নভোচারীদের খুব সতর্ক থাকতে হয়। নভোচারীরা যদি যথেষ্ট পরিমাণ সতর্ক না থাকে তাহলে ডি অরবিট বানে সয়ুজের স্পিড বেশি থাকবে। ফলে বাহনটি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ না করে আবার মহাকাশ স্টেশনের দিকে অগ্রসর হবে।

আবার যদি ডি অরবিট বানে প্রবেশ করা হয় তাহলে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের গতি অনেক বেশি হবে। অনেক বেশি গতিতে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করলে সয়ুজের গতি এতটাই বেশি হবে যে নভোচারীরা সিদ্ধ হয়ে যাতে পারে।সয়ুজের সবচেয়ে উপযোগী ডি অর্বিড বান হচ্ছে সেকেন্ডে ১২০ মিটার। সয়ুজের সঠিক ডি অর্বিড বানের পর বায়ুমন্ডলে প্রবেশের পরপরি বাহনটি তিনটি অংশ ভাগ হয়ে যায়। এই তিনটি অংশ হলো ১/ অরবিট মডিউল ২/ ডিসেন্ট মডিউল এবং ৩/ সার্ভিস মডিউল।

১/ অরবিট মডিউল

এখানে অরবিট মডিউলের কাজ হল যখন সয়ুজের মাধ্যমে নভোচারীদের পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয় ঠিক সেই সময় অরবিট মডিউলে নভোচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হয়। যেমন খাদ্য। ঔষধপত্র সহ অন্যান্য সরঞ্জাম। আবার সয়ুজ যখন পৃথিবীতে ফিরে আসে তখন এই মডিউলে রাখা হয় ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে তৈরি হওয়া ময়লা আবর্জনা এবং নভোচারীদের মলসহ ইত্যাদি।

২/ ডিসেন্ট মডিউল

ডিসেন্ট মডিউলে থাকে মহাকাশ স্পেস স্টেশন থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসা নভোচারীরা। এই মডিউলে চড়েই নভোচারীরা মহাকাশ ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে যান এবং ফিরে আসেন। এখানকার সর্বোচ্চ ক্যাপাসিটি তিনজন।

৩/ সার্ভিস মডিউল

সার্ভিস মডিউল মূলত পৃথিবীতে ফিরে আসা বাহনটির মূল ইঞ্জিন। যেখানে বাহনটির জন্য প্রয়োজনিয় জ্বালানি জমা করা থাকে। সার্ভিস মডিউল ব্যবহার করেই ডি অর্বিদ বান করা হয়।

মডিউলটি তিনটি অংশে বিভক্ত হওয়ার পর একে অপর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। যাতে করে কোন রকম সংঘর্ষ সংঘটিত না হয়। মাঝখানের ডিসেন্ট মডিউল ছাড়া বাকি দুইটা মডিউল সরাসরি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে এবং বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই বাতাসের সংঘর্ষে আগুন লেগে পুড়ে যায়।

অন্যদিকে ডিসেন্ট মডিউল বক্র পথে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে। মডিউলটি বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করার পূর্বে বায়ুমণ্ডলে বাতাসের সংঘর্ষে প্রায় ৩ হাজার ডিগ্রী ফারেনহাইটের মত তাপমাত্রা উৎপন্ন হয়। এত বেশি তাপমাত্রার কারণে মডিউলটির চারপাশের বাতাস প্লাজমাতে পরিণত হয়।

ঠিক এই মুহূর্তে কন্ট্রোলরুমের সঙ্গে নভোচারীদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ডিসেন্ট মডিউলটি যখন বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে তখন এর গতিবেগ ঘন্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করার পর বায়ুমণ্ডলের বাতাস একটি প্রেকের মতো কাজ করে। যার ফলে বায়ুমন্ডলে প্রবেশের 8 মিনিটের মধ্যেই ডিসেন্ট মডিউলটির গতি কমে গিয়ে দাঁড়ায় ঘন্টায় প্রায় ৮০০ কিলোমিটার।

ঠিক এই সময়টাতে মডিউলটি ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উপরে অবস্থান করে। সাড়ে ১০ কিলোমিটার উপরে থাকা অবস্থায় ডিসেন্ট মডিউলটির তিনটি প্রাসুট ওপেন হয়ে যায়। সর্বশেষ যখন ৮ কিলোমিটার উচ্চতায় ডিসেন্ট মডিউলটি অবস্থান করে তখন ওপেন করা হয় আরও একটি প্রাসুট।

যেখানে আরেকটি বেকাপ প্রাসুট রাখা হয়। প্রাসুট খোলার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অটোমেটিক হয়ে থাকে। যখন ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫ কিলোমিটার উপরে ডিসেন্ট মডিউলটি অবস্থান করে তখন হিট শীল থেকে ডিসেন্ট মডিউলটি সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। এরপর নভোচারীদের অবস্থানগত সিট থেকে কিছুটা উপরে উঠে আসে এবং নভোচারীরা তাদের হাতপা গুটিয়ে রাখে।

পাশাপাশি খেয়াল রাখে যেন কখনোই তাদের জিহবা দাঁতের মাঝখানে অবস্থান না করে। কেননা মডিউলটি যখন ভূপৃষ্ঠে আঘাত করবে তখন নভোচারীদের শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এরপর ডিসেন্ট মডিউলটি এক মিটার উপরে থাকা অবস্থায় শর্ট রকেট নিচের দিকে আঘাত করে।

এতে করে মডিউলটির গতি ঘন্টায় পাঁচ কিলোমিটারে নেমে আসে। আর এভাবেই সয়ুজের মাধ্যমে নভোচারীরা ইন্টারন্যাশনাল মহাকাশ স্টেশন থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করে।

Related Articles

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।