রাজনীতি

সুইস ব্যাংকে কিভাবে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়? কারা খুলে এই অ্যাকাউন্ট

সুইস ব্যাংক একাউন্ট খোলার নিয়ম! বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থপাচার নিয়ে তুমুল আলোচনার সমালোচনার মধ্যেই নতুন তথ্য প্রকাশ করল সুইস ব্যাংক।

সুইস ব্যাংক একাউন্ট খোলার নিয়ম

সুইজারল্যান্ডে ব্যাংকের কেন্দ্রীয় বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে। দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা করা টাকার পরিমান এক বছরের ব্যবধানে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। বাংলাদেশীদের নামে সেখানে রাখা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে ৩০ কোটি ৮১ লাখ ফ্রা। টাকা হিসেবে যা প্রায় ২ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। ২০২০ সাল পর্যন্ত সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশীদের নামে থাকা গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্রা।

২০২৩ সালের সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে জমা করা অর্থের পরিমাণ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে গণমাধ্যম। বিশ্বের কয়েক হাজার ব্যাংক থাকা সত্বেও ধনকুবেররা সুইস ব্যাংকেই কেন অর্থ জমা রাখে? এখানে গচ্ছিত অর্থ কতটা নিরাপদ? কারা অর্থ জমা রাখেন সুইস ব্যাংকে? একাউন্ট খুলতেই হয় বা কিভাবে? সুইস ব্যাংকের বিস্তারিত তথ্য নিয়েই আজকের পোস্টটি। আশা করি বন্ধুরা পোস্টটি স্ক্রিপ্ট না করে পুরো টি পড়বেন।

সুইচ ব্যাংক কি

সুইস ব্যাংক বলতে সুইজারল্যান্ডের যে কোন ব্যাংকে বুঝায়। এটি আসলে নির্দিষ্ট কোন একটি ব্যাংকে বুঝানো হয় না। বরং এর মাধ্যমে একটি ব্যাংকিং নেটওয়ার্ককে নির্দেশ করা হয়। সুইস ব্যাংকের হিসেব অন্য আরেকটি সাধারণ ব্যাংকের মতোই। তবে সুইস ব্যাংকের এমন কিছু নীতি ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকের দিকে ঝুকছে। দেশটির সব ব্যাংকে নিয়ন্ত্রণ করে সুইচ ফ্যাডারেল ব্যাংকিং কমিশন বা সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সুইস ব্যাংকে কারা অর্থ রাখে

ব্যাংকগুলোতে ব্যক্তির তথ্য গোপন রাখাই সুইজারল্যান্ডের আইন।এ কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা, আমেরিকা এশিয়া সহ তৃতীয় বিশ্বের দুর্নীতিবাজ সামরিক, বেসামরিক, শাসন, স্বৈরশাসক, রাজনীতিবিদ এবং উন্নত বিশ্বের অসাধু ব্যবসায়ীদের অর্থ লুকিয়ে রাখা বড় জায়গা এই সুইট ব্যাংক। অর্থ বা সম্পদ লুকিয়ে রাখার জন্য এর চেয়ে বড় জায়গা আর পৃথিবীতে নেই।

কঠোর গোপনীয়তা ও ঝুঁকির না থাকার কারণে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেন সুইস ব্যাংকে। সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তার সুবিধা নিয়ে  মানি লন্ডারিং নতুন কিছু নায়। তাই মানি লন্ডারিং এর সঙ্গে জড়িত অনেকেই সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার করে থাকেন বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তাই অপরাধীদের অবৈধ টাকার প্রধান গন্তব্য সুইস ব্যাংক।

 সুইস ব্যাংকে কালো টাকার পাহাড়

বিশ্বের ৮৬ টি দেশের নাগরিকদের ব্যাংক একাউন্ট সম্পর্কে সেই দেশের সরকারকে জানায় সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কোন কোন দেশের নাগরিক ঐ ব্যাংকে একাউন্ট খুলেছে সেই সম্পর্কে তথ্য দেয় সুইজারল্যান্ড ফেডারেল টেক্স এডমিনিস্ট্রেশন। সেই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের নাম। সরকারি হিসাবের বাইরেও ডামি একাউন্ট বা ডামি সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখেন।

আবার এদের বাইরে প্রবাসীরাও অবৈধভাবে সেখানে টাকা রাখেন। তাই এই হিসাব দেখে কালো টাকার পরিমাণ জানা সম্ভব নয় বলছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। তবে সুইচ ব্যাংকে বাংলাদেশ ও ভারতীয়দের  গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। সেই সঙ্গে দেশগুলোতে মানি লন্ডারিং এর অভিযোগ প্রকট হওয়ায় অধিকাংশ অর্থই কালো টাকা বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশীদের টাকার পাহাড়

দেশে যখন টাকা পাচার ঠেকানোর তোর ঝোর চলছে তখন নজিরবিহীন গতিতে সুইস ব্যাংকে টাকা জমিয়েছেন বাংলাদেশীরা। গত এক বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫৫ শতাংশ বেড়েছে ২০২৩ সালের শেষে দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশীদের জমা অর্থের পরিমাণ আগের বছরের ৫৬ কোটি ৩০ লাখ ফ্রা থেকে বেড়ে ৮৭ কোটি ১১ লাখ ফ্রা হয়েছে। বর্তমান একটার সমান ৯৫ টাকা ৮০ পয়সা হিসাব ধরলে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা।

টাকার হিসেবে ২০২০ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের ৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা জমা ছিল। ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পরপর তিন বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের অর্থের পরিমাণ কমার পর ২০২৩ সালে বড় ধরনের টাকা জমা হয়েছে।

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের ইতিহাস

সুইট ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অর্থের পরিমাণ প্রথমবার ১০ হাজার কোটি সুইচ ফ্রা ছারিয়ে যায় ২০০৬ সালে। ৯ কোটি ৭২ লাখ সুইচ ফ্রা থেকে ঐ বছর জমার পরিমাণ দারায় ১২ কোটি ৪৩ লাখ সুইচ ফ্রা। এরপর ২০০৭ সালে জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ২০ কোটি ৩০ লাখ সুইচ ফ্রা হয়। নির্দিষ্ট গ্রাহকের তথ্য না দিলেও গত এক দশম ধরে প্রতি বছরের প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 ১৫ বছরের রেকর্ড ভাঙল ভারত

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে শুধু ভারতীয়দের জমা আমানতের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার ৫০০ কোটি রুপি। যা কিনা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৮ সালের শেষে ভারতীয়দের গুঞ্চিত অর্থের পরিমাণ ছিল ১২,৬১৫ কোটি রুপি। যা ২০১৯ সালে অনেকটাই কমে যায়। ২০১৯ সালের শেষের দিকে ভারতীয়দের সুইস ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ছিল ৬,৬২৫ কোটি রুপি। এখান থেকে ২০২০ সালে এক লাফে আমানতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার 700 কোটি রুপি। ২০২৩ সালে সেই টাকার অংকটা রেকর্ড প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে ৩০ হাজার ৫০০ কোটি রুপি হয়।

সুইস ব্যাংকে বিত্তশালীদের আগ্রহ কেন

বিশ্বজুড়ে ধনী ব্যক্তিদের অর্থ সুইস ব্যাংকে রাখার আগ্রহের অন্যতম মূল কারণ দেশটির গোপনীয়তার নীতি। সুইজারল্যান্ডের আইনে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয়। টাকার  উৎস তারা জানতে চায় না। সুইচ আইন অনুসারে একজন ব্যাংকার কখনোই কোন গ্রাহকের হিসাবের কোন তথ্য প্রকাশ করতে পারেন না। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেকোনো সময় ব্যাংক হিসেবের যাবতীয় তথ্য পেতে পারেন। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের ব্যবস্থাটাই এমন। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী কখনোই কোন হিসেবের তথ্য প্রকাশ করতে না পারেন। সেজন্য ১৯৩৪ সালে একটি আইন পাস করে সুইজারল্যান্ড। তবে একেবারেই কোনো তথ্য প্রকাশ করা না গেলেও বিদেশী অপরাধীদের ধোরা ছোয়া বাইরে থেকে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই কয়েকটি ক্ষেত্রে গ্রাহকের তথ্য প্রকাশের দিকনির্দেশনা দিয়েছে সুইচ সরকার। যেমন দেওয়ানী মামলা,  বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলা, অপরাধ সম্পৃক্ততা যেমন মানি লন্ডারিং, কর ফাঁকি ইত্যাদি অপরাধ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে ব্যাংক তাদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য থাকবে।

সুইস ব্যাংকে এই অর্থ রাখার আরেকটি কারণ হচ্ছে কম ঝুঁকি। সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতি ও অবকাঠামো খুবই স্থিতিশীল। ফলে সভাবতই ঝুঁকির পরিমাণও অনেক কম থাকে। একই সঙ্গে সুইট ব্যাংকাররা খুবই দক্ষ এবং গ্রাহকের অর্থ কিভাবে বিনিয়োগ করতে হবে সে ব্যাপারেও তারা যথেষ্ট পারদর্শী। তাছাড়া সুইচ ফ্রাকে বিশ্বের অন্যতম স্থিতিশীল মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সুইস ব্যাংকে হিসাব খোলার নিয়ম

যে কেউ চাইলেই সুইট ব্যাংকে হিসাব খুলতে পারে। সুইস ব্যাংকে হিসাব খুলতে বৈধ পরিচয় এর ব্যাপারে নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমস্ত সম্পদের উৎস দেখাতে হবে। বড় অংক ডিপোজিট করার ক্ষেত্রে অন্য ব্যাংক হিসাবের স্টেটমেন্ট দেখানোর প্রয়োজনও হতে পারে এবং প্রয়োজনে সেই টাকার উৎসেরও যথাযথ কাগজপত্র লাগে। বিদেশীদের অনেকে মূলত সশরীরে উপস্থিত হয়েই হিসাব খোলার জন্য আবেদন করতে হয়। পাঁচ লাখ ডলার বা প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা থাকলে খুলতে পারা যায় সুইচ হিসাব।

ঝুঁকিতে সুইচ ব্যাংক

রমরমা ব্যবসার যুগে সুইফ ব্যাংকগুলোর সংখ্যা কেবলই বেড়েছে। কিন্তু চাপ বাড়তে থাকায় কমতে থাকে ব্যাংকের সংখ্যা। যেমন ১৯৯৬ সালে সুইস ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ৪০৩ টি ২০১৯ সালে তা কমে হয়েছে ১৫৭ টি ।আইন ভঙ্গ বা অনিয়মের জন্য এখন পর্যন্ত ৮৫ টি সুইট ব্যাংকের ৫৫০ কোটি ডলার জরিমানা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাংকের একটি ইউবিএস ২০০৯ সালে জরিমানা দেয় ৭৮ কোটি দলের ডলার এবং আরেক বড় ব্যাংক ক্রেডিট সুইচ ২০১৪ সালে জরিমানা দেয় ২৬০ কোটি ডলার বিশ্বব্যাপী সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সুইস ব্যাংকের অংশ কমেছে তাই তুলনামূলকভাবে সুইস ব্যাংকগুলো তাদের জৌলুস হারাচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

তবে পশ্চিমাদের মতো সুশাসনের বুলি আওড়ানো সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে কঠোর গোপনীয়তার নীতির কারণে বিশ্বব্যাপী কালো টাকা পাচারকারীদের সংখ্যা বাড়ছে বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্য দিয়ে একদিকে দেশটি যেমন অপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে সহিংসতা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে সম্মতি দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

Related Articles

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।